‘কিন্তু গানটা গাইতে গিয়ে যা হওয়ার তা–ই হলো...’
মঞ্চ, চলচ্চিত্র, সংগীত—সব অঙ্গনেই সমানতালে কাজ করে চলেছেন ইডিনা মেনজেল। আমেরিকান মিউজিক অ্যাওয়ার্ড, বিলবোর্ড মিউজিক অ্যাওয়ার্ড, টনি অ্যাওয়ার্ডের মতো পুরস্কার জেতার পাশাপাশি ‘ডিজনি লিজেন্ড’ও পেয়েছেন এই মার্কিন শিল্পী। ১৫ মে ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার সমাবর্তনে বক্তৃতা দিয়েছেন তিনি।
ছেলেবেলা থেকে মানুষের মুখে শুনে এসেছি, গলার স্বরই আমার শক্তি। ২০২৩ সালের স্নাতকেরা, আমার বিশ্বাস তোমাদের সঙ্গে এখানেই আমার মিল।
ছোট্ট এই জীবনে এরই মধ্যে তোমরা বিশ্বমন্দা, মুদ্রাস্ফীতি, মহামারি, বিদ্রোহ, মি টু আন্দোলন, জলবায়ু সংকট, স্মার্টফোন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের উত্থান, মানবজিনের পূর্ণাঙ্গ বিন্যাস, আধুনিক ওষুধের জাদু, আরও না জানি কত কী দেখে ফেলেছ। এখন প্রশ্ন হলো, কখন কীভাবে তোমরা তোমাদের গলার স্বরের যথাযথ ব্যবহার করবে। ফিসফিস করবে, নাকি চিৎকার? ঘোষণা দেবে, নাকি প্রশ্ন তুলবে? বলবে, নাকি শুনবে? তোমার কথার ধ্বনি কি আরও বহুগুণ হয়ে ছড়িয়ে পড়বে, নাকি বাধাগ্রস্ত হবে? তোমার রাগ করা কি সমীচীন? তোমার দুঃখ কি অর্থবহ? তোমার ‘আইডিয়া’ কি ভালো কিছু বয়ে আনছে?
এখানে বসেও হয়তো কিছুটা উদ্বেগে ভুগছ। কারণ, অসাধারণ এক যাত্রা শেষে নতুন করে আবার অকল্পনীয় এক পথে পা বাড়াতে যাচ্ছ তোমরা। আজ শুধু একটা বার্তাই আমি দিতে এসেছি—নিজেকে গুটিয়ে রেখো না। তোমার উদ্বেগকে কাজে লাগাও এবং নিশ্চিত করো যে তোমার কথা সবাই শুনছে।
গলা গেল ভেঙে
আজ থেকে ২০ বছর আগে, ঠিক এই দিনেই আমি সান ফ্রান্সিসকোর এক মঞ্চে উইকেড অ্যালবামের ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ারের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।
দিনটা এত সহজে আসেনি। আমাকে অডিশন দিতে হয়েছে। ক্রিয়েটিভ টিম আমাকে ‘ডিফায়িং গ্র্যাভিটি’ গানটা শোনানোর জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। তোমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো গায়ককে জিজ্ঞেস করলেই বুঝতে পারবে, গানটা খুব কঠিন। শেষের দিকে অনেক উঁচু মাত্রায় গাইতে হয়।
তো আমি দিন-রাত চর্চা করে অডিশনে হাজির হলাম। পরিচালক, প্রযোজকদের সামনে দাঁড়ানোর সময় মনে হচ্ছিল, আমি একদম প্রস্তুত। কিন্তু গানটা গাইতে গিয়ে যা হওয়ার তা–ই হলো। শেষের দিকে গিয়েই মাত্রাটাত্রা সব ভজকট পেকে গেল। ভীষণ মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। পাগলের মতো চিৎকার শুরু করলাম। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে বাদ্যযন্ত্রীদের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আরেকবার ধরুন।’ পরেরবার একদম ফাটিয়ে দিলাম। মাত্রাও হলো ঠিকঠাক।
আমরা সবাই মানুষ। বিশ্বমানের পড়ালেখা আর নিরলস চেষ্টার পরও তোমার ব্যবসা হয়তো মুখ থুবড়ে পড়বে, তোমার পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়তো কাজে লাগবে না। তোমারও হয়তো সুর কেটে যাবে। আমার মতো তোমরাও কেউ কেউ হয়তো রাগে ফেটে পড়বে। আবার কেউ হয়তো একদম চুপসে যাবে। যা-ই হোক, হাল ছেড়ো না।
সেই অডিশনের বছর কয়েক পর উইকেডের পরিচালক জো ম্যানটেলো আমাকে বলেছিলেন, প্রথমবার গলা ভাঙার পরই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, আমাকে দিয়ে হবে। আমার জেদই তাঁর মন জয় করে নিয়েছিল। মনে রেখো নিখুঁত হওয়া অসাধ্য, মানবিক হওয়া নয়। এটাই তোমাকে তোমার গন্তব্যে নিয়ে যাবে।
পুরোনো গান, নতুন অর্থ
টানা কয়েক বছর আমি সপ্তাহে উইকেড–এর আটটি করে শো করেছি। ‘ডিফায়িং গ্র্যাভিটি’ সেই উঁচু মাত্রায় গেয়েছি বহুবার। কয়েকবার সুর কেটেও গেছে।
শিল্পীর জীবন কখনো কখনো পুনরাবৃত্তিময়। একই শব্দ বারবার বলতে হয়। একই গান বারবার গাইতে হয়। তোমাদের বাসার বাচ্চাদের মুখে ডিজনির একটা গান বারবার শুনে শুনে তোমরাও হয়তো বিরক্ত, সে জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী। (ডিজনির ফ্রোজেন সিনেমার বিখ্যাত ‘লেট ইট গো’ গানটি গেয়েছিলেন ইডিনা মেনজেল। পরে শিশুদের কাছে গানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়—বি. স.)
একটা গোপন কথা বলি। একই কথা বারবার বলতে আমার খুব একটা খারাপ লাগে না। বরং ভালো লাগে। যত যা-ই হোক, আমি তো একজন অভিনেতা। নিজের কণ্ঠস্বর শুনতে মন্দ লাগে না। মানুষের মনোযোগ পেতে ভালো লাগে। কণ্ঠস্বর ব্যবহার করতে পারছি বলে আমি কৃতজ্ঞ। একই গান যখন বারবার গাই, প্রতিবার গানের সুর-কথা নতুন করে আবিষ্কার করি, শ্রোতাদের সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হই।
বছর কয়েক আগে আমি পিটসবার্গে গিয়েছিলাম। এটা ট্রি অব লাইফ সিনাগগে গোলাগুলির (২৭ অক্টোবর ২০১৮) ঘটনার কয়েক সপ্তাহ পরের কথা। সেখানে কনসার্টে গাইছিলাম, কিন্তু একটু দ্বিধান্বিত লাগছিল। বুঝতে পারছিলাম, শ্রোতারা তখনো শোকাহত। আমি নিজেও শোক কাটিয়ে উঠতে পারিনি। সেদিন মঞ্চে একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে আমি আরও একবার ‘নো ডে বাট টুডে’ গেয়েছিলাম। ‘দেয়ার ইজ অনলি নাউ, দেয়ার ইজ অনলি হিয়ার, গিভ ইন টু লাভ অর লিভ ইন ফিয়ার’—গানটার অর্থ সেদিন নতুন করে বুঝেছি।
পৃথিবী নতুনত্বে বিশ্বাসী
তোমাদের এমন অনেক শিক্ষক আছেন, যাঁরা একই ইতিহাস বছর বছর পড়ান। বর্তমানে দাঁড়িয়ে তোমরা সেই পুরোনো ইতিহাসের নতুন কী অর্থ পাও? অনেক অর্থনীতিবিদ একই বাজার পরিস্থিতি বছরের পর বছর দেখেন। তোমাদেরও যখন একই কাজ বারবার করতে হবে, তোমরা কী করবে?
এই প্রসঙ্গেই আমি আমার শেষ কথায় আসি। তোমরা একটা দল, সেটা ঠিক। কিন্তু তোমরা প্রত্যেকে আলাদাও।
পৃথিবী আমাদের সবাইকে কোনো না কোনো তকমা দিতে চায়, কোনো না কোনো দলে ফেলতে চায়। কিন্তু তোমার সীমানা তার চেয়ে অনেক বড়। যত ভূমিকায় নিজেকে দেখতে চাও, দেখো। চার বছর কিংবা তার চেয়েও বেশি সময় ধরে তোমরা আজকের দিনের জন্য তৈরি হয়েছ। আমরা সবাই জানি, একটা কিছু মঞ্চস্থ করার চেয়ে এর প্রস্তুতিতেই সময় লাগে বেশি। মহড়া শেষ, এখন তুমি মঞ্চে তোমার অংশটা করতে প্রস্তুত। মনে রেখো চিত্রনাট্য অনুযায়ী সব হবে না। উপস্থিত বুদ্ধি কাজে লাগাতে হবে। পৃথিবী যতটা ঐতিহ্যনির্ভর, তার চেয়ে বেশি নতুনত্বে বিশ্বাসী। সুরেলা কম, বেসুরো বেশি।
মঞ্চের আলোয় যখন দাঁড়াবে, বুক দুরুদুরু করার কারণে কেউ তোমাকে দোষারোপ করবে না। আমরা একই মঞ্চের মানুষ, তাই সতীর্থ হিসেবে অনুরোধ করি, ভয় যেন তোমাকে থামিয়ে না দেয়। আবেগকেই আরও সংকল্পবদ্ধ হতে কাজে লাগাও। মনপ্রাণ দিয়ে তোমার চরিত্রটা করে যাও।