কোথাও দেখা হলেই হাসিমুখে কথা বলত রুদ্র
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সারা দেশ হয়ে উঠেছিল উত্তাল। এই অস্থির সময়ে অনেক শিক্ষার্থীই হারিয়েছেন তাঁদের সতীর্থকে। পড়ুন এমনই একজনের শোকগাথা। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রুদ্র সেনকে নিয়ে লিখেছেন তাঁরই বন্ধু আনিছুর রহমান
৬ জুলাই ২০২৪। সেদিন স্লোগান দিতে দিতে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে এসে প্রথম রাস্তা অবরোধ করি। সেই সময় শুরু হয় তুমুল বৃষ্টি। আমার কাছে ছাতা ছিল না। তাকিয়ে দেখি, আমার বন্ধু রুদ্র সেনের কাছে ছাতা আছে। সে নিজেই বলল, ‘আয় আমার ছাতার নিচে।’ পরে একই ছাতার নিচে দুজন দাঁড়িয়ে এবং বসে স্লোগান দিচ্ছিলাম। ‘কোটা না মেধা, মেধা মেধা’, ‘সাস্টিয়ান সাস্টিয়ান, এক হও এক হও’। প্রায় এক ঘণ্টা রাস্তা অবরোধ করে আমরা স্লোগান দিয়েছিলাম। কে জানত, তার সঙ্গে সেটাই হবে শেষ স্মৃতি।
আমরা দুজনই উত্তরবঙ্গের ছেলে। তাই ক্যাম্পাসে যাওয়ার আগেই ফেসবুকে ওর সঙ্গে পরিচয়। অন্য বিভাগের শিক্ষার্থী হওয়ায় নিয়মিত দেখা হতো না। কিন্তু কোথাও দেখা হলেই হাসিমুখে কথা বলত। এত অমায়িক ও পরোপকারী মানুষ খুব কম দেখেছি। ১৯ জুলাই তার মৃত্যুর সংবাদটা শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। ৬ তারিখের স্মৃতিটুকু বারবার মনে পড়ছিল।
রুদ্র সেন ছিল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড পলিমার সায়েন্স (সিইপি) বিভাগের ২০২১-২২ বর্ষের শিক্ষার্থী। ওর মৃত্যুর বেদনাদায়ক বর্ণনা শুনেছি এক ছোট ভাইয়ের কাছে। ১৮ জুলাই সারা দেশই ছিল উত্তাল। সেদিন বিকেলে বেশ কয়েকজন বন্ধুবান্ধব মিলে ওরা একসঙ্গে বের হয়েছিল। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে অনেক ঝামেলা চলছিল। মারামারি, পাল্টাপাল্টি ধাওয়ায় সুরমা গেট, ইউনিলিভার ও তপোবন গেটের দিকে চলে যায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
তপোবনের দিকে সবাই একটা নিরাপদ জায়গায় দাঁড়ায়। হঠাৎ খবর আসে, শিক্ষার্থীদের মেসে মেসে নাকি পুলিশ হানা দেবে। স্বাভাবিকভাবেই ওরা দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়।
ভারী বৃষ্টির কারণে সিলেটের আশপাশের এলাকা তখন ডুবে গিয়েছিল। পুলিশের ভয়ে সবাই তখন কী করবে, ভেবে দিশাহারা। অনেকেই কলাগাছ দিয়ে ভেলা বানিয়ে চলাফেরা করছিল। রুদ্ররা কয়েকজনে মিলে ও রকম একটি ভেলায় উঠে পেছন দিক দিয়ে তাদের সিনিয়রের বাসায় যাচ্ছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তারা ভেলা থেকে পড়ে যায়। তিনজন নাকি সাঁতার কেটে উঠতে পেরেছিল, কিন্তু রুদ্র পেরে ওঠেনি। শুনেছি এক এলাকাবাসী ওকে বাঁচাতে পানিতে ঝাঁপ দিয়েছিলেন, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে তিনিও আহত হন। এরপর রুদ্রকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথেই রুদ্র মারা যায়।
কে এই মৃত্যুর দায়ভার নেবে? এভাবে মরার জন্য কি রুদ্রকে ক্যাম্পাসে পাঠিয়েছিলেন ওর মা?