রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ কেন আলাদা
‘ছোটবেলায় বাংলা সিনেমা দেখে আমার বিচারক হওয়ার ইচ্ছা হয়েছিল। বড় হয়েও আইন পেশার প্রতি অন্য রকম একটা টান কাজ করত। তাই নিজেকে সেভাবেই তৈরি করি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ মোট চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। কিন্তু সবার কাছেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের বিশেষ প্রশংসা শুনেছি। তাই এই ঐতিহ্যবাহী বিভাগে ভর্তি হতে আমাকে দ্বিতীয়বার ভাবতে হয়নি,’ বলছিলেন তৌহিদুজ্জামান নাঈম। সদ্যই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন এই তরুণ। নাঈম যেমনটা শুনেছেন, তা কিন্তু একেবারে ভুল নয়। বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস (বিজেএস) পরীক্ষার কয়েক বছরের ফলের দিকে তাকালেই এর প্রমাণ পাওয়া যায়। বিজেএসে পরপর চার বছর যাঁরা প্রথম হয়েছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী। এ ছাড়া নানা কারণেই বিভাগটির সুনাম আছে। কীভাবে দেশের আইন শিক্ষার্থীদের মধ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় একটি বিশেষ জায়গা করে নিল, সেটাই জানতে চেষ্টা করেছিলাম আমরা।
আমিও পারব
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৩ সালে। যে কয়টি বিভাগ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু, তার মধ্যে একটি আইন বিভাগ। ১৯৫৪ সালে এখানে আইন বিষয়ে দুই বছরের পাসকোর্স চালু হয়। ১৯৭০ সালে স্নাতক ও ১৯৭৩ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি দেওয়া শুরু হয়। তখন থেকেই বাংলাদেশের আইন ও বিচার অঙ্গনে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি চোখে পড়তে থাকে। পরে বিজেএস পরীক্ষায়ও সাফল্যের ধারাবাহিকতা ধরে রাখেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এখন দেশে সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে ১৫টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়ানো হলেও বিজেএস পরীক্ষায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিশেষ অবস্থান ধরে রেখেছেন। ১৩ থেকে ১৬তম বিজেএস পরীক্ষায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শুধু যে প্রথম স্থান অর্জন করেছেন, তা নয়, এই নিয়োগ পরীক্ষায় সুযোগ পাওয়া প্রার্থীদের সংখ্যার বিবেচনায়ও এগিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
এমন সাফল্যের পেছনে কারণ কী? জানতে চাইলে ১৫তম বিজেএস পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করা আশিক-উজ-জামান বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয় মূল কারণ আমাদের বিভাগের শিক্ষার্থীদের মানসিকতা। আমরা সব সময়ই আমাদের বিভাগের পরম্পরা ধরে রাখতে চেষ্টা করি। ব্যাপারটা এমন যে আমার সিনিয়র যেহেতু পেরেছে, চেষ্টা করলে আমিও পারব। উদাহরণগুলো আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে। ফলে প্রথম দিকের জায়গাগুলো অর্জনের চেষ্টা থাকে সব সময়।’
হালনাগাদ পাঠ্যক্রম
আইন বিভাগের শিক্ষাক্রম নিয়ে কথা হচ্ছিল সদ্য প্রকাশিত বিজেএস পরীক্ষার ফলাফলে প্রথম হওয়া নুসরাত জেনির সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমাদের আইন বিভাগের পাঠ্যক্রম আমার কাছে খুবই যুগোপযোগী বলে মনে হয়। বিশেষ করে এই সময়ে আইন বিষয়ে পেশা গড়তে যে বিষয়গুলো জানা বেশি জরুরি, সেগুলোর ওপর চতুর্থ বর্ষে জোর দেওয়া হয়। সিপিসি, সিআরপিসি, পেনাল কোডের মতো বিষয়গুলো শেষের দিকে পড়ানোর ফলে আমাদের শিক্ষার্থীরা চাকরির পরীক্ষায় ভালো করে বলে আমার ধারণা। তাই একাডেমিক পড়াশোনার মাধ্যমে বিজেএস পরীক্ষার প্রস্তুতি অনেকাংশেই হয়ে যায়।’
বিজেএস পরীক্ষায় প্রথম জেনি স্নাতকেও প্রথম স্থান অর্জন করেছিলেন। একাডেমিক সেই পড়াশোনাই তাঁকে জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষায় এগিয়ে রেখেছে বলে মনে করেন তিনি। জেনি বলেন, ‘প্রথম বর্ষ থেকেই আমি একাডেমিক পড়াশোনা নিয়ে সিরিয়াস ছিলাম। তাই সব কটি আইনই আমার ভালো করে পড়া ছিল। বিজেএসের সিলেবাসের একটি বড় অংশই যেহেতু আইনসংক্রান্ত, তাই একাডেমিক পড়াশোনা আমার কাজে লেগেছে।’
নুসরাত জেনির মতো একই মত দিলেন আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাদিকুল সাগর। তিনি বলেন, ‘আমরা যুগের চাহিদার সঙ্গে সংগতি রেখে আমাদের বিভাগের পাঠ্যক্রম হালনাগাদ করি। এসবের পাশাপাশি এখানে ব্যবহারিক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিই। আমরা আমাদের বিভাগে চতুর্থ বর্ষে ট্রায়াল অ্যাডভোকেসি নামে একটি কোর্স পড়াই। যেখানে মামলার বিভিন্ন স্টেজগুলো হাতেকলমে শেখানো হয়। এভাবে আইনের বিভিন্ন বিষয় ও পরিস্থিতিগুলো হাতেকলমে শেখানোর চেষ্টা করা হয়। শিক্ষার্থীরাও সব সময় বলে যে এভাবে শেখানোর ফলে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় তাদের সুবিধা হয়।’
ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কও শিক্ষার্থীদের ভালো ফলাফলের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বলে মনে করেন তিনি। সাদিকুল সাগর বলেন, ‘আমাদের বিভাগে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক খুবই ভালো। খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে আমাদের শিক্ষা-কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এ কারণেও শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় আগ্রহ পায় বলে আমার মনে হয়।’
স্বপ্নের পরিধি বড়
পেশাভিত্তিক চাকরির পরীক্ষায় ভালো ফলাফল শুধু নয়, বিভাগটিতে গবেষণা ও উচ্চশিক্ষার পরিসর আরও বড় করতে চান আইন বিভাগের সভাপতি হাসিবুল আলম প্রধান। তিনি বলেন, ‘আমি বিভাগের দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রতিবছরই বিজেএস পরীক্ষায় আমাদের শিক্ষার্থীরা প্রথম স্থান অর্জন করেছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি বড় অর্জন। কিন্তু আমাদের এক দিকে এগিয়ে থাকলে হবে না। তাই আমরা আইন বিষয়ে রিসার্চ কনফারেন্স আয়োজন করছি। গবেষণাকে আমরা গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি। পাশাপাশি বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে পারস্পরিক সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্কের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের জন্য আরও বেশি সুযোগ তৈরির চেষ্টা করে যাচ্ছি।’