ছেঁড়া স্যান্ডেল হাতে স্টেডিয়ামে যাওয়া মেয়েটিই দেশের দ্রুততম মানবী হলেন ১৬ বার
জাতীয় অ্যাথলেটিকসের ৪৮তম আসরেও দ্রুততম মানবী। আগেও ১৫ বার দেশের দ্রুততম মানবী হয়েছেন। অথচ ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড পর্যন্ত পৌঁছাতে কত কাঠখড়ই না তাঁকে পোড়াতে হয়েছে। সেই সব গল্পই সজীব মিয়াকে শোনালেন শিরিন আক্তার
সেদিন আমাদের স্কুল বন্ধ ছিল। অনেক সময় স্কুল বন্ধ থাকলেও প্র্যাকটিস ঠিকই হতো। দুপুরে মনে হলো, আকবর (আলী) স্যারের কাছে খোঁজ নিই। ২০০৬ সালের কথা এটা, আজকের মতো সবার হাতে তখন মুঠোফোন ছিল না। বড় আপার কাছ থেকে ১০ টাকা নিয়ে গ্রামের মোড়ে যাই। এক দোকান থেকে স্যারকে কল দিই। স্যার বলেন, ‘আজ তো প্র্যাকটিস নেই, তবে খেলা আছে। তুমি এখন আসতে পারবে?’
বললাম, ‘পারব।’
ফোনের বিল দিয়ে আমার হাতে তখন তিন টাকা আছে। সেই টাকায় যতটুকু পথ যাওয়া যায় গেলাম। তারপর দিলাম দৌড়। মাঝপথে স্যান্ডেলটা ছিঁড়ে গেল। স্যান্ডেল ছেঁড়ার ভয়ে পিচঢালা রাস্তা ছেড়ে মাটির রাস্তায় হাঁটতাম। দ্রুত দৌড়াতে গিয়ে সেটাই ছিঁড়ল। স্যান্ডেলটা বাড়িতে ফেরত নিতে হবে, তাই সেটাকে বগলদাবা করেই স্টেডিয়ামে চলে গেলাম।
আমার বাবা কৃষক মানুষ। আমরা চার বোন। বড় বোনের অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে গেছে। সাতক্ষীরার দহখোলা গ্রাম ছেড়ে শহরের কারিমা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ক্লাস সিক্সে ভর্তি হয়েছি। পড়াশোনায় আমি ভালো না, দৌড়ের কারণে সবাই ভালো স্টুডেন্টদের মতো গুরুত্ব দেয়। অন্যদের থেকে এই আলাদা গুরুত্বের ব্যাপারটা আমাকে আনন্দ দেয়।
স্টেডিয়ামে এসে দেখি, মেয়েদের ট্রায়াল শেষ। স্যার বললেন, ছেলেদের সঙ্গে দেবে?
আমি রাজি।
পরে দেখা গেল, সম্মিলিতভাবে আমিই সেরা। তখন আমার কাছে জানতে চাওয়া হলো—অ্যাথলেটিকস না জিমন্যাস্টিকস, আমি কিসে আগ্রহী? এসবের কিছুই আমি বুঝি না। বললাম, ‘আমি দৌড় খেলতে চাই।’
সবাই হেসে উঠেছিল কি না, আজ আর মনে নেই। তবে বাছাইয়ে যে টিকে গেছি, তা বুঝে গেলাম। সেই সঙ্গে জানলাম, শুধু খেলাধুলা নিয়েই একটা প্রতিষ্ঠান আছে, নাম বিকেএসপি। আমি সেখানে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছি।
কিন্তু মা–বাবা রাজি না। এগিয়ে এলেন আকবর স্যার। তিনি আমার স্কুলশিক্ষক না হলেও শিক্ষক হিসেবেই সম্মান পান। দক্ষ কোচ হিসেবে অভিভাবকেরা তাঁর ওপর ভরসা করেন। স্যার বাড়িতে গিয়ে মা-বাবাকে বোঝালেন। আমি বিকেএসপিতে ট্রায়াল দিয়ে গেলাম। তখন কেউ টিকলে চিঠি দিয়ে জানাত বিকেএসপি।
সেই চিঠির অপেক্ষায় থাকলাম।
একদিন গ্রামে হইহই রইরই পড়ে গেল। আমার নামে চিঠি এসেছে। বাচ্চা একটা মেয়ের নামে সরকারি চিঠি, এর চেয়ে বড় খবর সেদিন গ্রামে দ্বিতীয়টি নেই। সবাই গ্রামের মোড়ে জড়ো হয়েছে। ডাকপিয়ন বাবার হাতে চিঠি তুলে দিয়েছে। সেখানেই খাম খোলা হলো। জানা গেল, আমি বিকেএসপিতে সুযোগ পেয়েছি। পরদিনই ভর্তির শেষ দিন।
পাড়া-প্রতিবেশী সবাই খুশি। শুধু দুজনের মন খারাপ—মা আর বাবার। তাঁদের মন খারাপ টের পেয়ে আমি কাঁদতে শুরু করলাম। আমাকে যে ভর্তি হতেই হবে। সারা দিন কিছু খেলাম না। পরামর্শ করতে মামাদের কাছে গেলেন বাবা। সিদ্ধান্ত হলো আমাকে বিকেএসপিতে দিয়ে আসবেন ছোট মামা।
রাতে মামার সঙ্গে বাসে উঠলাম। পথে মামা আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন—ভর্তির দরকার নেই। ঘুরেফিরে আমরা বাড়িতে চলে আসব।
মনে মনে আমি ভাবছিলাম, আগে তো যাই!
বিকেএসপিতে সব ঘুরে ঘুরে দেখলেন মামা, শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বললেন। তাঁর মন ঘুরে গেল। আমি ভর্তি হয়ে গেলাম। ক্লাস সেভেনে।
তুমি তো ফার্স্ট হয়েছ
বিকেএসপিতে ভর্তির পর পাঁচ কি ছয় মাস গেছে। কোনো এক প্রতিযোগিতায় সিনিয়ররা অংশ নিয়েছেন। দেখার জন্য আমাদের আনা হয়েছে। গ্যালারিতে বসে আছি, হঠাৎ এক শিক্ষক এসে আমাকে বললেন, তুমি ৪০০ মিটারে দৌড়াবে?
আমি এককথায় রাজি।
যে আপুর দৌড়ানোর কথা ছিল, তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আমি দৌড়ের পোশাক সঙ্গে আনিনি। আপু তাঁর পোশাক আমাকে দিলেন। সেই পোশাক পরেই দৌড়ালাম। ৩০০ মিটার দৌড়ের পর কীভাবে কী হয়েছে আমার মনে নেই। কারণ, ততক্ষণে অজ্ঞান হয়ে গেছি। জ্ঞান ফেরার পর শুনি, সবাই ডাকতে ডাকতে বলছে, ‘তুমি ফার্স্ট হয়েছ, তুমি ফার্স্ট হয়েছ।’
সবার পরিচিত হয়ে গেলাম। বিকেএসপিতে ভালো রেজাল্ট করলে কিংবা ভালো খেললে বেতন মওকুফ হয়ে যায়। পড়াশোনায় পারব না, তাই খেলায় সেরাটা দিতে থাকলাম। এক বছর পর থেকে আমার বেতন মওকুফ হয়ে গেল। এইচএসসি পর্যন্ত আমাকে আর বেতন দিতে হয়নি। ২০০৭ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ছিলাম দ্রুততম বালিকা, দ্রুততম কিশোরী। ২০১৪ সালে জাতীয় অ্যাথলেটিকসে ১০০ মিটারে সোনা জিতে হলাম দ্রুততম মানবী।
জাতীয় পর্যায়ে সাফল্যের পর বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে খেলোয়াড় হিসেবে যোগদানের সুযোগ পেলাম।
প্রতিবারের অনুভূতিই এক
২০১৪ সালে এইচএসসি পাস করি। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে ভর্তির সুযোগ পেলাম। খেলার পাশাপাশি পড়াশোনা চলতে থাকল। আমি যতবার দৌড়ে সেরা হই, প্রতিবার একই রকম রোমাঞ্চকর অনুভূতি হয়। ২০১৪ সালে আমার নামের সঙ্গে ‘দ্রুততম মানবী’ যুক্ত হওয়ার পর যেমন অনুভূতি হয়েছিল, এবার ১৬তম বার হয়েও সেই একই অনুভূতি হয়েছে।
খেলতে খেলতেই একসময় বুঝেছি, মা-বাবাসহ আমার পরিবার আমাকে নিয়ে গর্ব করে। দিনে দিনে এলাকার মানুষের কাছে তাঁদের সম্মান বেড়েছে। আমার ছোট দুই বোন স্কুল-কলেজ শেষ করে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। আমিও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে ওদের বিশ্ববিদ্যালয়ে স্পোর্টস সায়েন্সে মাস্টার্স করছি।
আমাকে দেখে নাকি অনেক মেয়ে সাহস পায়। পরিচিত অনেকেই বলে, মেয়ে হলে যেন শিরিনের মতো হয়! এই শিরিন মানে খেলোয়াড় শিরিন নন, মানুষ শিরিন। অন্যদের এই চাওয়াটা আমাকে ভীষণ অনুপ্রেরণা আর উৎসাহ জোগায়।
ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে এই উৎসাহই আমার শক্তি।