যেভাবে স্কুটার আমার জীবন বদলে দিল
একটা স্কুটার যে জীবন বদলে দিতে পারে, কখনো ভেবেছিলাম?
দেখতে মোটামুটি ছোটখাটো। ভ্রুম ভ্রুম করে ছুটে চলা দশাসই বাইকগুলোর মতো অমন ‘সিক্স প্যাক অ্যাবস’ নেই। নিরীহ বাহনটিই রোদ, ঝড়, বৃষ্টি, যানজট, হরতাল, বিধিনিষেধে আমার পথচলাটা সহজ করেছে। আরেকটু বড় পরিসরে বললে—জীবনটাকে সহজ করেছে।
তিন বছরে এক দিনও বাসে চড়ার জন্য উসাইন বোল্ট হতে হয়নি। রিকশাচালক ভাইকে রাজি করাতে হাতে-পায়ে ধরতে হয়নি। এমনকি সিএনজি অটোরিকশাচালকের কাছ থেকে ভাড়া শুনে চোখ কপালেও তুলতে হয়নি! ভাবলেই বুকের ভেতর একটা কেমন-কেমন স্বস্তি বোধ হয়। টাকা তো বেঁচেছেই, বেঁচেছে টাকার চেয়ে মূল্যবান সময়।
বছর কয়েক আগেও আমাদের দেশে স্কুটার খুব একটা পরিচিত ছিল না। পুরোনো মডেলের ভেসপাগুলোই লোকে চিনত। আধুনিক স্কুটারে চড়ে সিগনালে দাঁড়ালেই আশপাশ থেকে মানুষ কত– কী প্রশ্ন করত!
‘ভাই, এটা কি ব্যাটারিতে চলে?’
‘দাম কত?’
‘মাইলেজ তো বোধ হয় বেশি না…’
এখন অবশ্য শহুরে মানুষের চোখ স্কুটার দেখে অভ্যস্ত। অনলাইনে-অফলাইনে স্কুটারচালকদের বেশ বড় একটা গোষ্ঠী তৈরি হয়ে গেছে। ঢাকায় তো বটেই, ঢাকার বাইরেও নানা গ্রুপের খোঁজ পাই। দল বেঁধে তাঁরা ‘রাইডে’ বের হন। একজন আরেকজনের সমস্যায় এগিয়ে আসেন।
অথচ স্কুটার কেনার পর শুরুর দিকে বন্ধুদের একরকম কটাক্ষই শুনেছি। মাঝেমধ্যেই কেউ না কেউ বলত, ‘বাইক না কিনে স্কুটার কিনলি কেন?’
কিন্তু একদিন একটা ঘটনার পর বন্ধুমহলে আমার স্কুটারের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে।
তখন রমজান মাস। স্কুটারে এক বন্ধুকে নিয়ে গিয়েছিলাম কারওয়ান বাজারে। ২০-২৫ জনের ইফতারের একটা আয়োজন ছিল সেদিন। বিশাল আকারের দুটো তরমুজ, কমলা, আপেল, শসা, বিরিয়ানি…আরও একগাদা বাজার পাদানিতে রেখে যখন ফিরছি, পেছনে বসা বন্ধুটি দুষ্টুমি করে বলছিল, ‘তোর স্কুটার দিয়ে তো বাসা বদলানো যাবে!’
বাসাবদল ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি হয়ে গেল। তবে এটা ঠিক, চালের বস্তা থেকে শুরু করে লাগেজ, এমনকি তরকারিভর্তি বড় বড় সসপ্যান বহন করার অভিজ্ঞতাও আমার হয়েছে।
সব অভিজ্ঞতা যে সুখকর, তা-ও নয়। যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে মাঝরাস্তায় দুই-একবার বন্ধ হয়ে গেছে, তখন স্কুটারটাকে আমার সঙ্গে ‘হাঁটিয়ে’ নিতে হয়েছে দীর্ঘ পথ। তবু, আমার বাহন-কহনে কৃতজ্ঞতার পাল্লাই ভারী।
যাঁরা মনে মনে স্কুটার কেনার কথা ভাবছেন, ‘সিনিয়র চালক’ হিসেবে এই সুযোগে একটা পরামর্শ দিতে চাই। নিরাপদ আর ভদ্রলোকের বাহন হিসেবে এমনিতেই স্কুটারের বেশ সুনাম আছে। তবে আপনার চলাচলটা আরও নিরাপদ হবে, যদি একটা নিয়ম মেনে চলেন—শুরু থেকেই হর্ন না বাজানোর অভ্যাস করুন। হর্ন না চাপলে আপনার ব্রেক চাপার অভ্যাস হবে, ধীরে চলার অভ্যাস হবে। জানিয়ে রাখি, স্কুটার চালানো কিন্তু খুবই সহজ। শুধু দুটি বিষয় শিখলেই হয়। ১. কীভাবে চলতে হয়। ২. কীভাবে থামতে হয়। প্রথমটার চেয়ে দ্বিতীয় শিক্ষাটাই বেশি জরুরি।
অনেকে হয়তো জেনে হাসবেন। স্কুটার আমাকে কিছু নতুন জীবনদর্শনও দিয়েছে। পথচলার সময় যখন দেখি বড় বড় গাড়ি, বাইক শাঁ শাঁ করে পাশ দিয়ে ছুটে যাচ্ছে; অনেক সময় ওদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গতি বাড়াতে ইচ্ছা করে। পাল্লা দিয়ে এগোতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবি, ওর গন্তব্য আর আমার গন্তব্য তো এক নয়। ওর জীবন আর আমার জীবনও এক নয়। রেসে শামিল হওয়ার চেয়ে যাত্রাটা উপভোগ করাই বড়। সামনে যদি এগোতে থাকি; হোক ধীরে কিংবা জোরে, কোনো এক সিগন্যালে আবার দেখা হয়েই যাবে।