ছাত্রদের বাঁচাতে জীবন দিয়েছিলেন যে শিক্ষক

‘স্যার! এ মুহূর্তে আপনাকে ভীষণ দরকার স্যার,’ মারা যাওয়ার এক দিন আগে ড. সৈয়দ মোহাম্মদ শামসুজ্জোহাকে উদ্দেশ করে ফেসবুক পোস্টে লিখেছিলেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। শহীদ এই অধ্যাপকের নাম জানলেও তাঁর সাহসিকতার কথা এ প্রজন্মের অনেকেই হয়তো জানে না। ২০২০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোর অনলাইনে প্রকাশিত একটি লেখা থেকে জেনে নেওয়া যাক।

ড. সৈয়দ মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা
ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে ১৮ ফেব্রুয়ারি তারিখটি বেশ গুরুত্ব বহন করে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে ১৯৬৯ সালের এই দিনে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে শহীদ হন ড. সৈয়দ মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা। শামসুজ্জোহা প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষক, যিনি পাকিস্তানি মিলিটারির হাতে শহীদ হন। তাঁর মৃত্যু ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানকে প্রভাবিত করে এবং আইয়ুববিরোধী আন্দোলনকে বেগবান করে।

সৈয়দ মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা ১৯৩৪ সালের ১ মে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৪৮ সালে বাঁকুড়ার স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯৫০ সালে বাঁকুড়া খ্রিষ্টান কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৩ সালে বিএসসি এবং ১৯৫৪ সালে এমএসসি করেন। ১৯৬৪ সালে লন্ডন ইম্পেরিয়াল কলেজ থেকে পিএইচডি অর্জন করেন। কর্মজীবনের শুরুতে জোহা পাকিস্তানের অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরিতে সহযোগী কারখানা পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫৯ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে ওয়াহ ক্যান্টনমেন্টে সহকারী পরিচালক পদে যোগ দেন। তিনি ১৯৬১ সালে রয়্যাল অর্ডিন্যান্স থেকে ইস্তফা দিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেভেলপমেন্ট কর্মকর্তা হিসেবে নতুন কর্মজীবন শুরু করেন। একই বছরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৬ সালে পদোন্নতি লাভ করে রিডার হন। শামসুজ্জোহা ১৯৬৫ সালে শাহ মখদুম হলের আবাসিক শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৬ সালে ওই হলের প্রাধ্যক্ষ হন। তিনি ১৯৬৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।

সৈয়দ মোহাম্মদ শামসুজ্জোহার আরও একটি পরিচয় হলো তিনি ভাষাসৈনিক। জোহা ছিলেন তাঁর হলের নিয়মিত ফুটবলার। অ্যাথলেটিক ও অন্যান্য খেলায়ও ছিলেন পারদর্শী। ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হকি দলের নিয়মিত খেলোয়াড়।

মৃত্যুর আগের দিনই অধ্যাপক শামসুজ্জোহাকে নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলেন আবু সাঈদ

‘প্লিজ, ডোন্ট ফায়ার’

৬ দফা দাবি এবং শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আনা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণ আন্দোলন গড়ে তোলে। স্থানীয় জেলা প্রশাসন ১৯৬৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে। সেদিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গের উদ্দেশ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকসহ মুক্তিপ্রত্যাশী জনতা মিছিল বের করে। মিছিলটি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ অধ্যক্ষের বাসভবনের সামনে পৌঁছালে পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে ছাত্র-শিক্ষকসহ স্বাধীনতাকামী সাধারণ জনগণের সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে অনেকেই আহত হন, আবার অনেকেই গ্রেপ্তারও হন।

পরদিন ১৮ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়-সংলগ্ন নাটোর রোডে স্থানীয় প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে। উত্তেজিত ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভাঙার প্রস্তুতি নেন। তাই সশস্ত্র বাহিনীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেটে প্রস্তুত রাখা হয়। কিন্তু আন্দোলনরত ছাত্ররা সব প্রতিরোধ ও বাধাকে সঙ্গী করে মেইন গেটের প্রাচীর টপকে বের হয়ে পড়েন। সে পরিস্থিতিতে স্বাধীনতাকামী ছাত্রদের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনী রাইফেল উঁচিয়ে প্রস্তুতি নিতে থাকলে ছাত্ররা তাঁদের গাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দেন। এ পরিস্থিতিতে পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন হাদির সঙ্গে কথা বলার জন্য জোহা এগিয়ে যান। তাঁকে অনুরোধ করেন যেন সেনাদের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের মারাত্মক পদক্ষেপ নেওয়া না হয়। মেইন গেট-সংলগ্ন নাটোর রোডে ছাত্রদের ঢল নামতে শুরু করলে পাকিস্তানি মিলিটারি বাহিনী ছাত্রদের ওপর গুলি করতে উদ্যত হয়। তখন জোহা হাত উঁচু করে মিলিটারিদের উদ্দেশে বলতে থাকেন, ‘প্লিজ, ডোন্ট ফায়ার! আমার ছাত্ররা এখান থেকে এখনই চলে যাবে...!’

এ প্রসঙ্গে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আবদুল খালেক বলেন, সেনা কর্মকর্তারা জোহাকে তাঁর পরিচয় জিজ্ঞেস করেছিলেন। জোহা বলেছিলেন যে তিনি ‘রিডার’। সেনা কর্মকর্তারা শুনেছিলেন ‘লিডার’। জোহা সেনাসদস্যদের শান্ত থাকতে আহ্বান জানান। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনী সেদিন তাঁর ওই অনুরোধ শোনেননি। পাকিস্তানি বাহিনী বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে, রাইফেল দিয়ে গুলি করে তাঁকে আহত করে। তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। পথে ব্যারিকেড থাকায় তাঁকে হাসপাতালে নিতে দেরি হয়ে যায়। হাসপাতালে নেওয়ার পর অস্ত্রোপচার টেবিলে শামসুজ্জোহা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

শামসুজ্জোহার মৃত্যুর ঘটনা চলমান মুক্তির সংগ্রামে নতুনত্ব যোগ করে; বেগবান হয়ে ওঠে আন্দোলন। জেনারেল ইয়াহিয়ার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য হন আইয়ুব খান। তাঁর মৃত্যু দেশবাসীকে স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকে ধাবিত করে।

পরিতাপের বিষয়, জোহার মৃত্যুদিবসে স্মৃতিচারণা করেন শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যাঁরা অধ্যয়ন করেছেন, তাঁরা। (সংক্ষেপিত)

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র