২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

স্বল্প খরচে ঘর সাজান

ঘর সাজাতে আমরা সবাই কমবেশি ভালোবাসি। কিন্তু পরিবারের মাসের খোরাক জুগিয়ে, ডাক্তার-বদ্যির ফি আর পানি-বিদ্যুতের বিল মিটিয়ে ঘর সাজানোর নিত্যনতুন অনুষঙ্গ কেনা আসলেই খুব দুরূহ হয়ে পড়ে। অথচ একটু বুদ্ধি খরচ করলে আর কিছুটা সৃজনশীলতার পরিচয় দিলে যৎসামান্য খরচেই নিজেদের বাড়িঘর নান্দনিক রূপে সাজিয়ে নেওয়া যায়।

ঘর সাজিয়ে তুলুন নিজের মতো করে
ছবি: প্রথম আলো

এ ক্ষেত্রে প্রথমেই বলতে হয় নিজেদের সুপ্ত সৃজনশীল প্রতিভার বিকাশ ঘটানোর কথা। পুরো বিশ্বেই এই নিজেরা করি, ‘ডু ইট ইয়োরসেলফ’ বা সংক্ষেপে ‘ডিআইওয়াই’-এর ধারণা অত্যন্ত জনপ্রিয় ও কার্যকর গৃহসজ্জার ক্ষেত্রে। অবসর সময়ে আমরা অনেকেই শুধু মুঠোফোন, টেলিভিশন, নেটফ্লিক্স, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইত্যাদির মধ্যে ডুবে থেকে অলস সময় পার করি। অথচ শখের কাজ যেগুলো আগে ঘরে ঘরে প্রচলিত ছিল, সেগুলো নিঃসন্দেহে এর থেকে অনেক ভালো আর ঘর সাজানোর অনন্য সব উপকরণ হাজির করে দিতে পারে প্রায় বিনা পয়সায়।

শখের সূচিকর্ম বা কুরুশ কাঁটার কাজের কথাই ধরা যাক না! খুঁজলে আজও আমাদের অনেকের বাড়িতে আলমারির কোণে বা পুরোনো ট্রাংকে মাতামহীর হাতে পরম যত্নে সেলাই করা ভরাট কাজের ফুল, লতা, পাতা, পাখি বা ‘মায়ের দোয়া’ লেখা এক টুকরো ভাঁজ করা কাপড় পাওয়া যাবে। অমূল্য স্মৃতিবিজড়িত এই শিল্পকর্মগুলো ফ্রেমিং করে নিলে একেবারে অসাধারণ সব ওয়ালপিস পেতে পারি আমরা। এই সূচিশিল্পগুলো থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আর সেই সঙ্গে ইন্টারনেটে পাওয়া হাজারো নমুনা দেখে নিজের কল্পনার মিশেলে এমন সূচিকর্ম, ক্রস স্টিচের কাজ, কুরুশ কাঁটার কাজ করে বাঁধিয়ে নিয়ে তা দিয়ে ঘরের সৌন্দর্য অসামান্য রকমের বাড়িয়ে তোলা যায়।

আফিফা লাইলির মতো আপনারাও সূচিকর্ম করতে পারেন অবসরে
ছবি: দীপু মালাকার, প্রথম আলো

আগের দিনের মতো টি-কোজি, ন্যাপকিন, বালিশ বা কুশনকভার, টেবিলক্লথ ইত্যাদিতেও নিজের হাতের কাজের ছোঁয়া অত্যন্ত সুরুচির পরিচয় দেয়। আবার সৃষ্টিশীল মনকে কাজে লাগালে রংবেরঙের কাগজ দিয়ে ‘কুইলিং’ করা যায়, ধান-ডাল-শর্ষে আঠা দিয়ে বসিয়ে চিত্র তৈরি করা যায়। নিজে আঁকিবুঁকি করা শখের হাঁড়ি, রিকশা পেইন্টিংয়ের আদলে রাঙিয়ে নেওয়া বাক্স, রঙিন মোম বা পুঁতি দিয়ে বানানো শোপিস, কাপড়ের পুতুল—এসবই ঘর সাজানোর অসাধারণ অনুষঙ্গ হয়ে উঠতে পারে। আর ছবি আঁকার শখ থাকলে তো কথাই নেই। তেলরং, জলরং বা মিশ্র মাধ্যমে করা নিজের হাতের চিত্রকর্ম, ক্যালিগ্রাফি বা ভাস্কর্য দিয়ে সাজানো বসার ঘরটি ঘরে-বাইরের সবার মুগ্ধতার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। আর এতে যে আত্মিক প্রশান্তি বা সন্তুষ্টি পাওয়া যায়, তা লাখ টাকা দিয়ে কেনা দামি দামি শোপিসে কখনোই মিলবে না।

এই সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে ঘর সাজানোর ব্যাপারটিতে শিশুদেরও অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। তাদের মতামত ও রুচিকে গুরুত্ব দিয়ে তাদের নিজেদের বানানো অরিগ্যামি (কাগজ ভাঁজ করে বানানো শিল্প), এঁটেল মাটি বা প্লে ডো দিয়ে বানানো নানা রকম শিশুসুলভ জিনিস, লেগো ব্লক দিয়ে গড়া গাড়ি-বাড়ি, এসব দিয়ে তাদের নিজেদের ঘরটি সাজিয়ে-গুছিয়ে নিতে সাহায্য করলে অল্প বয়সেই তাদের মধ্যে গৃহসজ্জার ব্যাপারে সুরুচি আর আগ্রহ তৈরি হবে।

বাড়ি সাজানোর কাজে শিশুদেরও সঙ্গে নিন। তাদের তৈরি অরিগামি দিয়ে সাজিয়ে ফেলুন তাদের ঘর
ছবি: কোলাজ

এমন কোনো পরিবার নেই, যেখানে শিশুরা কমবেশি আঁকাজোঁকা করে না। দেখতে যতই কাঁচা হাতের আর শিশুসুলভ হোক, তাদের রঙের ব্যবহার আর সৃষ্টিশীলতা কিন্তু বড়দের থেকে বিস্ময়কর রকমের বেশি। চোখ আর মনজুড়ানো এসব মোমরং বা জলরঙে আঁকা ছবি ফ্রেমবন্দী করে ঘরের দেয়ালে পরিকল্পনামাফিক সাজালে ঘরটি অন্য আলোয় ভরে উঠবে। বাড়িতে ফিরে সারা দিনের ক্লান্ত-বিধ্বস্ত শরীর-মন এক নিমেষেই সতেজ-সজীব হয়ে উঠবে সেদিকে চোখ পড়লেই—এ কথা হলফ করে বলা যায়।

আবার শিশুটি বড় হয়ে উচ্চশিক্ষার্থে বাড়ির বাইরে গেলে সেই দেয়ালজোড়া প্লেন, গাড়ি, ফুল আর গ্রামের দৃশ্য অমূল্য স্মৃতির মতো মা-বাবাকে বেঁচে থাকার প্রেরণা জোগাবে প্রতিনিয়ত। শিশুদের ছোটবেলার রংবেরঙের খেলনাগুলোও সুন্দরভাবে সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখা যায় বসার ঘরের এক কোণের তাকে। শিশুদের সঙ্গে নিয়ে করা বিভিন্ন পারিবারিক গ্রুপ প্রজেক্টের মতো শখের শিল্পকর্ম একদিকে যেমন ছুটির দিনগুলোকে প্রযুক্তিনির্ভরতা কাটিয়ে বর্ণিল করে তোলে, সেই সঙ্গে ঘর সাজানোর নান্দনিক সব উপকরণও জোগায়।

সূচিকর্মের মাধ্যমে বানানো শিল্পকর্ম ওয়ালপিস হিসেবে ব্যবহার করুন
ছবি: প্রথম আলো

আমাদের নিজেদের বা মা-বাবার ঘরে একটু খোঁজাখুঁজি করলেই আপাতদৃষ্টিতে কাজে লাগবে না মনে হয় এমন অনেক জিনিস পাওয়া যাবে, যা দিয়ে ঘর সাজালে একদম ব্যতিক্রমী একটি ভাব আসবে ঘরে। পূর্বপুরুষদের বিভিন্ন স্মৃতিচিহ্ন, যেমন পুরোনো আমলের গ্র্যান্ড ফাদার ক্লক, হুঁকা, পিতামহের ব্যবহার করা ছড়ি, চেয়ার, কলমদানি, রেডিও, নানি-দাদির পানদানি—এগুলো একটু অন্য রকমভাবে বসার ঘরে সঠিক কম্বিনেশনে রাখলে ঘরের আবহটাই বদলে যাবে।

পুরোনো পালঙ্ক, ট্রাংক, গ্রামোফোন, কারুকাজ করা বসার তেপায়া—এসবই একটু রং বা মেরামতি করে অত্যন্ত অভিজাত একটি রূপ দেওয়া যায়। আগে বিয়েবাড়িতে উপহার হিসেবে পিতলের পানপাত্র, সুরাই, ফুলদানি ইত্যাদি দেওয়ার প্রচলন ছিল। পুরোনো এসব সামগ্রীর অ্যান্টিক মূল্য আছে বলে বিভিন্ন বাণিজ্যিক বা ঘরোয়া পরিষ্কারক দ্রব্য ব্যবহারে পরিষ্কার করে তা দিয়ে ঘরের কোণটি অন্য রকমভাবে সাজিয়ে নেওয়া যায়। আবার অনেক সময় পুরোনো স্মৃতিবিজড়িত বেনারসি বা জামদানি শাড়িটির জমিনের সুতো ফেঁসে গেলে তার জমকালো নয়নাভিরাম আঁচলটি কেটে নিয়ে বাঁধাই করে নিলে একেবারে নজরকাড়া ও ব্যতিক্রমী ওয়ালপিস হিসেবে তা ব্যবহার করা যায়।

পুরোনো দিনের নানা জিনিসপত্র দিয়ে সাজিয়ে তুলতে পারেন আপনার গৃহকোণ
ছবি: প্রথম আলো

আমরা প্রবাসে নিজ দেশেও কোথাও বেড়াতে গেলে সেখান থেকে দামি সব স্যুভেনির বা স্মারক কেনার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ি। বিদেশে গিয়ে প্লাস্টিকের লন্ডন বাস, আইফেল টাওয়ার আর কক্সবাজারে গিয়ে চড়া দামে শামুক, কড়ি, ঝিনুক ও প্রবাল কিনে আনি ঘর সাজাতে। অথচ অনেক সময় সমুদ্রসৈকতে কুড়িয়ে পাওয়া এসব শামুক–ঝিনুক, ঝরনা বা জলপ্রপাতের পাশে পড়ে থাকা অন্য রকম কিছু রঙিন নুড়িপাথর ইত্যাদি দিয়ে খুব সুন্দরভাবে ঘর সাজানো যায়। আর এর পেছনের গল্পগুলো আমাদের মধুর সব স্মৃতি মনে করিয়ে দেয় এক নিমেষেই বহু বছর পরেও।

রোজকার প্রাতর্ভ্রমণ বেরোলেও কিন্তু অনেক সময়ে আপনা থেকে জন্মানো খুব শৈল্পিক অবয়বের কোনো শাখা–প্রশাখাযুক্ত শুকনো গাছের ডাল দেখতে পাওয়া যায়। শিকড় উপড়ে ফেলা একটু অন্য রকম গাছের গোড়াও মিলে যায় কখনোবা। বাড়িতে এনে ধুলো–মাটি পরিষ্কার করে ঘরে সাজিয়ে রাখলে অত্যন্ত শৈল্পিক এই প্রাকৃতিক ভাস্কর্য সবার নজর কাড়বে নিঃসন্দেহে। বিভিন্ন দৃষ্টিনন্দন পাতা ও ফুল সংগ্রহ করে এনে বিশেষ উপায়ে শুকিয়ে সেগুলো দিয়ে ফ্রেমবন্দী ড্রাইড ফ্লাওয়ার বা লিভস অ্যারেঞ্জমেন্ট বানানো যায়, যা এখন খুবই ফ্যাশনেবল।

দেয়াল বা ঘর সাজাতে যে একেবারে প্রথাগত ও গতানুগতিক ওয়ালপিস বা শোপিস কিনতে হবে, তার কোনোই বাধ্যবাধকতা নেই। ঘর সাজানো আসলে একটি সৃষ্টিশীল কাজ বা শিল্প। সৃজনশীল মনকে কাজে লাগালে একেবারে নামমাত্র খরচে বিচিত্র সব উপায়ে ঘর সাজিয়ে নেওয়া যায় মনের মতো করে। খেয়াল রাখতে হবে, ঘরের সামগ্রিক আবহ, যেমন: দেয়ালের রং, ঘরের কার্যকারিতা, আসবাবপত্রের সঙ্গে যেন এই সাজসজ্জা মানিয়ে যায়। আর সেই সঙ্গে একগাদা জিনিস একসঙ্গে এলোমেলো করে জড়ো না করে পরিকল্পনা অনুযায়ী সাজালে তবেই সাশ্রয়ী উপায়ে সাজানো এই ঘর আমাদের চোখ জুড়াবে, মন ভরাবে।