যে ৮টি কারণে আপনার ঘরের গাছ টেকে না
শহুরে জীবনে সবুজের ছোঁয়া পেতে আমরা ছাদে, বারান্দায় বাগান করি, অন্দরেও লালন করি অনেক রকমের গাছ। ছায়াবান্ধব ইনডোর প্ল্যান্ট বা ঘরের গাছ শোভা বাড়ায়, আমাদের মনটা করে সতেজ, পরিবেশের জন্য উপকারী তো বটেই। কিন্তু নানা কারণে ঘরের ভেতর সবসময় গাছ ভালো রাখা সম্ভব হয়ে ওঠে না। জেনে রাখুন যে ৮টি ভুলের কারণে ঘরের গাছ বা ইনডোর প্ল্যান্ট মরে যায়। সঙ্গে তার সমাধানও বলা হলো এখানে—
১. টবের পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা
আমাদের যেমন নিয়ম মেনে রোজ খাবার খেতে হয়, গাছের বেলাতেও তা-ই। কিন্তু সব গাছের খাবারের চাহিদা সমান নয়। কোনো গাছের পানি শোষণ ক্ষমতা বেশি, প্রতিদিনই পানি দেওয়া প্রয়োজন। আবার কোনো গাছের পানি শোষণ ক্ষমতা কম, প্রতিদিন পানি না দিয়ে টবের মাটি শুকিয়ে এলে তবেই পানি দিতে হয়। কেননা গাছ মরে যাওয়ার অন্যতম একটি কারণ হলো গাছে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি দেওয়া। টবে অতিরিক্ত পানি জমে গাছের শিকড়ে পচন ধরতে পারে। এই পচন থেকে একটা সময় গাছ মরেও যেতে পারে। এ কারণে পানি যেন জমে না থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
গাছের পাতা হলুদ হয়ে ঝরে পড়তে দেখলে বুঝে নেবেন, অতিরিক্ত পানি দিয়ে ফেলেছেন। তৎক্ষণাৎ পানি দেওয়ার মাত্রা কমিয়ে আনুন। প্রয়োজনে পানি দেওয়া বন্ধ করে সরাসরি সূর্যালোকে রাখুন। সহজে পানি নিষ্কাশনের জন্য ছিদ্রযুক্ত টবের ব্যবহার নিশ্চিত করুন।
ঢালাওভাবে সব গাছে সমান তালে পানি না দিয়ে গাছের ধরন বুঝে পানি দিন। খরা-সহনশীল ক্যাকটাস, স্নেক প্ল্যান্ট এবং জেড প্ল্যান্টের ক্ষেত্রে মাটি পুরোপুরি শুকিয়ে এলে তবেই পানি দিন। ফার্ন জাতীয় গাছ স্যাঁতসেঁতে মাটি পছন্দ করে, ফলে মাটিতে একটু ভেজা ভাব থাকতেই পারে।
আবার কিছু গাছ আছে, যেসব স্রেফ বোতলের পানিতেই দিব্যি বেঁচে থাকে। যেমন লাকি ব্যাম্বু, পথোস বা মানি প্ল্যান্ট। এসব গাছপানিতে মরে না বললে চলে। শুধু সপ্তাহে অন্তত একদিন পুরোনো পানি বদলে নতুন পানি দিলেই হলো।
২. প্রয়োজনের তুলনায় পানি কম দেওয়া
গাছের পাতা হঠাৎ করে ঝরে যাওয়া, কুঁচকে যাওয়া বা বাদামী বর্ণ ধারণ করা বা পুরো গাছটিই নেতিয়ে পড়ার মানে হলো গাছ তার প্রয়োজন অনুযায়ী পানি পাচ্ছে না। অতএব পানি দিয়ে গাছের তৃষ্ণা মেটান।
বৃষ্টিহীন বসন্ত ও গ্রীষ্মের মতো শুষ্ক আবহাওয়ায় গাছে একটু বেশি পানি দিতে হতে পারে। তবে সহজ সূত্র একটাই—একবার পানি দেওয়ার পর টবের মাটি শুকিয়ে এলে তবেই নতুন করে পানি দিন।
৩. চারার বয়স অনুপাতে ছোট কিংবা বড় আকারের টব নির্বাচন
আপনার কোনো একটি গাছ বহুদিন ধরে নির্দিষ্ট একটি টবে আছে। ইদানীং খেয়াল করছেন, গাছটার বৃদ্ধি যেন একটা জায়গায় থেমে আছে। পাতাগুলোও কেমন যেন বিবর্ণ, শুকিয়ে ঝরে পড়ছে। যখন পানি দেন, দ্রুতই মাটি শুকিয়ে যাচ্ছে। ঘন ঘন পানি দিতে হচ্ছে। এমন হলে বুঝতে হবে বহুদিন ধরে একই টবে থাকায় পুরো টব শিকড়ে ছেয়ে গেছে। গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি হয়ে আছে স্থবির।
উপায়? গাছটি এখন যে টবে আছে তার থেকে বড় আকারের টবে বা ড্রামে প্রতিস্থাপন করুন। ৮ ইঞ্চি টব হলে ১২ ইঞ্চি টবে, ১২ ইঞ্চি টব হলে ১৬ ইঞ্চি টবে, ১৬ ইঞ্চি টব হলে ২০ ইঞ্চি টবে নতুন করে মাটি প্রস্তুত করে গাছটি প্রতিস্থাপন করতে হবে।
আবার উল্টো দিকে, যদি দেখেন টবের মাটি দীর্ঘ সময় ভেজা থেকে যাচ্ছে, বুঝতে হবে, চারার বয়স অনুপাতে টবের আকার বড় হয়ে গেছে। আরও ছোট টবে দিতে হবে। তাই ছোট চারা শুরুতেই ছোট পাত্রে দিন। পরে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেবড় পাত্রে স্থানান্তর করুন।
৪. বেশি সূর্যালোক
ছায়াবান্ধব ইনডোর প্ল্যান্ট স্বভাবতই সরাসরি সূর্যের আলো পছন্দ করে না। রোদে গাছের পাতা ফ্যাকাসে হয়ে আসতে পারে, এমনকি পুড়েও যেতে পারে। তাই ঘরের জানালা কোন দিকে, তা বিবেচনায় রেখে গাছের অবস্থান ঠিক করুন। দক্ষিণ এবং পশ্চিমের জানালা পূর্ব এবং উত্তরমুখী জানালার চেয়ে বেশি সরাসরি সূর্যের আলো দেয়। ফলে ক্যাকটাস, কাঁটামুকুটের মতো গাছগুলো সরাসরি সূর্যের আলোতে রাখতে পারলেও অন্যদের সরাসরি রোদ থেকে দূরে রাখুন।
৫. উপযুক্ত টব নির্বাচন
গাছের জাত ও উচ্চতাভেদে টব নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ভুল গড়নের টব নির্বাচন গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। পানি নিষ্কাশনের সুবিধা আছে, এমন মাটির টব বেছে নেওয়া ভালো। তবে ফার্ন, এলোকেশিয়ার মতো যেসব গাছ একটু আর্দ্র বা ভেজা মাটি পছন্দ করে, সেসবকে চাইলে প্লাস্টিকের টবে রাখতে পারেন। অন্যদিকে ক্যাকটাস, সাকুল্যান্ট-জাতীয় রসাল কাণ্ডের গাছের জন্য মাটির টবই উত্তম। আবার অর্কিডের জন্য বেছে নিতে হবে ছিদ্রযুক্ত প্লাস্টিকের ঝুড়ির মতো বিশেষ টব। এ টবে মাটির কোনো প্রবেশাধিকার নেই! শুধু কোকো পিট বা নারকেলের ছোবড়াতেই অর্কিড গাছ বসিয়ে দিতে হয়। অন্য টবের মতো পানি না ঢেলে শুধু পানি স্প্রে করলেই হলো।
৬. টবে ভুল ধরনের মাটির ব্যবহার
অতিরিক্ত এটেল মাটি পানি নিষ্কাশনে বাধা দেয়। আবার অতিরিক্ত বেলে মাটি পানি ধরে রাখতে পারে না। তাই টবে মাটি প্রস্তুতের বেলায় উত্তম হলো বেলে-দোআঁশ মাটি বেছে নেওয়া। এ ছাড়া ক্যাকটাস এবং অন্যান্য খরা-সহনশীল জাত মরুভূমির মতো মাটিতে স্বাচ্ছন্দ্য। ক্যাকটাসের জন্য মাটি প্রস্তুত করতে বালু, হাড়ের গুঁড়া ও দোআঁশ মাটি ব্যবহার করা হয়। আর তা এমনভাবে প্রস্তুত করা হয়, যেন টবের অতিরিক্ত পানি সহজে বেরিয়ে যেতে পারে।
৭. আলোকস্বল্পতা
গাছের জন্য সূর্যের আলো লাগবেই, নাহলে সালোকসংশ্লেষণ হবে না। ইনডোর প্ল্যান্ট ছায়াবান্ধব হলেও এদেরও কিন্তু আলো-বাতাসের দরকার হয়। তাই সপ্তাহে অন্তত একদিন হলেও গাছগুলো রোদে দিন।
৮. গাছে কীটপতঙ্গ
পছন্দসই গাছের সতেজ সবুজ স্বাভাবিক চেহারা পাল্টে দিতে পারে পোকামাকড়ের আক্রমণ। ছত্রাকের সংক্রমণ আর মিলিবাগের আক্রমণই হয় বেশি। তবে পোকার আক্রমণ হলেই ভয়ের কিছু নেই। পোকা ও ছত্রাকের সংক্রমণ ঠেকাতে কীটনাশক হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন জৈব বালাইনাশক নিম তেল। প্রতি ২৫০ মিলিলিটার পানির সঙ্গে ১০ মিলিলিটার নিম তেল মিশিয়ে স্প্রে করতে পারেন। ১ লিটার নিম স্প্রে তৈরি করতে ১ লিটার হালকা গরম পানিতে ২ মিলিলিটার বা ৪-৫ ফোটা লিকুইড সাবান অথবা ডিস ওয়াশের সঙ্গে ৫ মিলিলিটার নিম তেল মেশাতে হবে। তারপর মিশ্রণটি ঠান্ডা হলে আক্রান্ত গাছগুলোতে স্প্রে করুন। আগাম আক্রমণ ঠেকাতে প্রতি ১৫ দিন পর পর এই নিম তেলের মিশ্রণ স্প্রে করতে পারেন।