আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত নারায়ণগঞ্জের বাড়িটি দেখতে কেমন?

স্থাপত্য অঙ্গনের নতুন নতুন কীর্তিকে স্বীকৃতি দিতে ৩৪ বছর ধরে ‘জে কে আর্কিটেক্টস অ্যাওয়ার্ডস’ দিয়ে আসছে ভারতের জে কে সিমেন্ট লিমিটেড। প্রতিযোগিতার সর্বশেষ সংস্করণে বিদেশি বিভাগে প্রায় ২৫০টি প্রকল্পের মধ্য থেকে বর্ষসেরা স্থপতি হয়েছেন বাংলাদেশের মাহমুদুল আনোয়ার। নারায়ণগঞ্জে তাঁর নকশা করা বাড়িটা দেখতে গিয়েছিলেন জিনাত শারমিন

বাড়িটির নাম রিয়াজ লফটছবি: মাহমুদুল আনোয়ারের সৌজন্যে

মাঠটি যেন বাড়িটির হৃদয়

‘রিয়াজ লফট’কে মাঠ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখলে ভুল হবে; বরং মাঠটিই বাড়িটির হৃদয়, আঙিনা। বাড়ি আর মাঠ মিলেই সম্পূর্ণ হয় এই স্থাপনা।

বাড়ির সামনে বিশাল মাঠ
ছবি: মাহমুদুল আনোয়ারের সৌজন্যে

তাই বাড়িটি তৈরির সঙ্গে সঙ্গে মাঠেরও নানা উন্নয়নমূলক কাজ চলেছে। মাঠে বোনা হয়েছে নতুন ঘাস। বাড়ির পাশাপাশি সেগুলোরও দেখভাল করা হয় নিয়মিত। তৈরি করা হয়েছে নতুন বার–পোস্ট। মাঠে লাগানো হয়েছে ফ্লাডলাইট। এ ছাড়া প্রয়োজনীয় নানা সংস্কার করে আধুনিকতার ছোঁয়া দিয়েছেন রিয়াজ উদ্দিন। মহল্লার মধ্যে সুন্দর এই মাঠটি এখন সহজেই চোখে পড়ে। সময়ের সঙ্গে মাঠটি হয়ে উঠেছে এই মহল্লার সামাজিকীকরণের একটা প্রাণকেন্দ্র। নিয়মিত এই মাঠে খেলে এলাকার শিশুরা। আবার হইরই করে মহসিন ক্লাবের বিভিন্ন প্রীতি ও আনুষ্ঠানিক ম্যাচের খেলাও সেখানে হয়। আসলে ব্যবসার পাশাপাশি খেলাধুলা, বিশেষ করে ফুটবল শিল্পপতি রিয়াজের আরেকটি আগ্রহের জায়গা। নিজেও নিয়মিত খেলাধুলা করতেন। ২০২২ সালে তাঁর হাত ধরেই নতুন জীবন পায় মহসিন ক্লাব। এই বাড়ি আর মাঠের খানিক দূরেই এই ক্লাবের কার্যালয়।

এদিক দিয়ে বাড়িটিতে প্রবেশ করতে হয়
ছবি: মাহমুদুল আনোয়ারের সৌজন্যে

ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার কৃতিত্বও এই মাঠের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে চান রিয়াজ। বললেন, ‘এই মাঠে আমি লাখ লাখবার পড়েছি, আবার উঠে দাঁড়িয়েছি। এই মাঠই আমাকে শিখিয়েছে, জীবনে পড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক, তবে আপনাকে উঠে দাঁড়াতেই হবে। কখনো হাল ছাড়লে চলবে না। তাহলে একসময় জয় আসবে। আসতেই হবে। আমার জীবনে যেটুকু যা সফলতা, এটাই তার রেসিপি।’

আরও পড়ুন

যে পাঁচ কারণে আলাদা এই বাড়ি

প্রথমত, বাড়িটি দেখে আপনি বুঝতেই পারবেন না যে এটি এত ছোট জায়গায় বানানো। স্থপতি মাহমুদুল আনোয়ার যাঁদের আদর্শ মানেন, তাঁদেরই একজন ইতালীয় স্থপতি রেনজো পিয়ানো। রেনজোর কাছে একবার জানতে চাওয়া হয়েছিল, ছোট একটা বাড়িকে বড় দেখানোর উপায় কী? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘বাড়িটির ভেতরে–বাইরে সাদা রং করুন। বড় বড় জানালা দিন। আর ঘরের ভেতর হালকা আসবাব ব্যবহার করুন।’

বাড়িটির পাশেই স্কুল
ছবি: মাহমুদুল আনোয়ারের সৌজন্যে

রিয়াজ লফটে এই তিনটিই আছে। পুরো বাড়িটিই সাদা। প্রথাগত জানালার বদলে বড় বড় কাচের দেয়াল ব্যবহার করা হয়েছে। নিচতলায় কর্মচারীদের থাকার জায়গায় প্রাকৃতিকভাবে আলো–বাতাস ঢোকানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে ‘জালুসি উইন্ডো’। কাচের দেয়াল টেনে সরালেই বাইরের আলো ঢুকে পড়ে। ঘরে যত প্রাকৃতিক আলো ঢুকবে, স্পেসটাকে তত বড় দেখাবে। এখানে কাচের দেয়াল সরিয়ে দিলে ঘরের জায়গাটুকু বাইরের সঙ্গে মিলে যায়। কাস্টমাইজ করে এই বাড়ির জন্য ছোট ছোট আসবাব বানিয়ে দিয়েছে আসবাবের দেশি ব্র্যান্ড ইশো। এসবের সঙ্গে স্থপতি মাহমুদুল আনোয়ার রিয়াদ ‘ভার্টিক্যালি’ খেল দেখিয়েছেন। যেহেতু প্রস্থে বা চওড়ায় তেমন জায়গা পাওয়া যায়নি, তাই উচ্চতা থেকে এখানে ‘স্পেস’ বের করেছেন স্থপতি। তিনতলা বাড়িটি উচ্চতার দিক থেকে ‘পাঁচতলা’। সেটিও এমনভাবে দুই ভাগ করা, যাতে মাথার ওপরে ছাদ অনেক উঁচু বলে ভ্রম হয়।

বাড়িটিতে আলো বাতাসের অভাব হয় না
ছবি: মাহমুদুল আনোয়ারের সৌজন্যে

দ্বিতীয়ত, একটা আধুনিক বাড়িতে যা কিছু থাকা প্রয়োজন, তার অনেক কিছুই এখানে আছে। কেন্দ্রীয় শীতাতপনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, জেনারেটর, লিফট, সিঁড়ি, স্টোরেজ, ড্রাই কিচেন, বাগান, পার্কিং, বাথরুমে জ্যাকুজি বাথটাব, সুইমিংপুল, হুইলচেয়ারে ওঠার ব্যবস্থা, কেয়ারটেকারদের জন্য আলাদা থাকার জায়গা—১ হাজার ৩০০ বর্গফুটের মধ্যেই এই সবকিছু রয়েছে। যাকে বলে ‘ইউটিলিটি ম্যানেজমেন্ট’–এর চূড়ান্ত ব্যবহার। রয়েছে বৃষ্টির পানিকে দূষণমুক্ত করে ব্যবহার করার ব্যবস্থা। বাড়ির প্রায় সবখানেই রয়েছে ‘পরোক্ষ আলো (ইনডিরেক্ট লাইটিং)’ ব্যবহারের সুযোগ। আলোর উৎস অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় না। ফলে আলো চোখে লাগে না। আবার আলোর সুষম বণ্টনও হয়। সব ইলেকট্রিক ও প্লাম্বিং তার, পাইপ, এসি থেকে শুরু করে দৃষ্টিকটু সবকিছু সুন্দরভাবে ঢেকে ফেলা হয়েছে।

একতলা থেকে আরেক তলায় ওঠার সিঁড়ি
ছবি: মাহমুদুল আনোয়ারের সৌজন্যে

তৃতীয়ত, বাড়িটি কংক্রিটের কাঠামোয় তৈরি। ফলে পুরো ভবনটা একসঙ্গে তোলা হয়েছে। ইট ব্যবহার করা হয়নি বললেই চলে। ‘এক্সপোজড’, ‘র’, ‘ব্রুটালিস্টিক’ কাঠামো ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে পেইন্টের ব্যবহার হয়েছে খুবই মিনিমাল। দরজার ফ্রেম ও নানা কিছু তৈরি হয়েছে গর্জন ও বার্মাটিক সেগুন কাঠ দিয়ে। সেই কাঠগুলোও আবার যথাসম্ভব প্রাকৃতিক অবস্থায় ব্যবহার করা হয়েছে। গাছগুলো যত বড়, কাঠও তত লম্বা রাখা হয়েছে। ফলে দরজাগুলো বেশ উঁচু উঁচু।

ডাইনিং এরিয়া
ছবি: মাহমুদুল আনোয়ারের সৌজন্যে

জায়গাটায় দুটো নারকেলগাছ লাগিয়েছিলেন রিয়াজ উদ্দিনের নানা। এই বাড়ির চতুর্থ বিশেষত্বটা হলো সেই গাছ দুটোকে অক্ষত রেখেই ভবনটি বানানো হয়েছে। তবে মহামারিকালে দীর্ঘ সময় ধরে নির্মাণকাজ চলায় একটা গাছ মারা যায়। মোদ্দাকথা, স্মৃতি সংরক্ষণের তাগিদ থেকেই তৈরি হয়েছে এই বাড়ি।

পঞ্চম আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো মাঠটাকে অনেকটা বাড়ির ‘এক্সটেনডেড অংশ’ বা উঠানের মতো করে চোখের সামনে রাখা।

লিভিং এরিয়া
ছবি: মাহমুদুল আনোয়ারের সৌজন্যে

২০২০ সালের শুরুতে বাড়ি তৈরির কাজ শুরু হয় আর ২০২১ সাল শেষ হয়ে যায়। বাড়িটি তৈরি করতে সব মিলিয়ে খরচ হয়েছে প্রায় ১০ কোটি টাকা। মা নূরজাহান বেগমের জন্য বাড়িটি তৈরি করেছেন রিয়াজ উদ্দিন আল মামুন। যদিও ছেলের সঙ্গে তাঁর ঢাকার বাড়িতেই থাকেন মা। বয়সের ভারে ন্যুব্জ নূরজাহান বেগম দুবার বাড়িটি ঘুরে গেছেন। বাড়িটিতে তাই স্থায়ীভাবে কেউ থাকে না। কয়েকজন কেয়ারটেকার বাড়িটির দেখাশোনা করেন।

 

বিশেষ দ্রষ্টব্য: এই প্রজেক্টের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যুক্ত ছিলেন ইপিলিয়ন গ্রুপের ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ম্যানেজার নাহিদ হোসেন। এই প্রতিবেদককে বাড়িটি ঘুরে দেখার ব্যবস্থা করে, বিভিন্ন সময়ে নানা তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছেন। তাঁকে ধন্যবাদ।

 (লেখাটি প্রথম আলোর বিশেষ ম্যাগাজিন বর্ণিল বসত নভেম্বর ২০২৪–এ প্রকাশিত)