অন্দরের সাজসজ্জায় ক্রমেই বাড়ছে সিলিংয়ের নকশার গুরুত্ব। ঘরের সিলিংয়েও আজকাল বিভিন্ন সাজের ছোঁয়া পাচ্ছে জনপ্রিয়তা। একেক ঘরে সিলিং–সজ্জার আবেদন একেক রকম। বিস্তারিত জানাচ্ছেন স্থপতি সাইফুর রহমান।
আধুনিক অন্দরসজ্জায় কৃত্রিম ছাদের রয়েছে আলাদা আকর্ষণ। তবে অনেক স্থপতি আর ইন্টেরিয়র ডিজাইনার মনে করেন, সিলিংয়ে খুব বাড়তি কিছু না থাকাই ভালো। অনেক সময় মিনিমালিস্টিক সিলিংই সবচেয়ে বেশি কার্যকর।
সিলিংয়ের মাধ্যমে স্কাই লাইট ও স্কাই উইন্ডোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এভাবে ছোট একটা জায়গাকে বড় একটা জায়গার সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার ফলে একটিকে আরেকটির অংশ মনে হয়। তখন ছোট জায়গাটুকু আর ছোট মনে হয় না। ঝুম বৃষ্টির সময় বাথরুমের সিলিংটি সরিয়ে ‘প্রকৃতির ঝরনা’তেই সেরে ফেলতে পারেন স্নান।
সাদা সিলিং–বর্ণিল সিলিং
আবাসিক ভবনের প্রতি তলার উচ্চতা সাধারণত ১০ ফুটের বেশি হয় না। সে ক্ষেত্রে সিলিংয়ে ভুল উপকরণ ও নকশার কারণে সেটি আরও ছোট দেখাতে পারে। তাই সেখানে যত হালকা রং ব্যবহার করা হবে, সেটি তত উঁচু দেখা যাবে। গাঢ় রং ব্যবহারে মনে হয়, সিলিংয়ের উচ্চতা কম, ঘরের জায়গাও কম। এ কারণেই সাধারণত সিলিংয়ে সাদা রং ব্যবহার করা হয়। ঘরের দেয়ালে যে রং ব্যবহার করা হয়েছে, সেই একই রং সিলিংয়ে ব্যবহার করতে পারেন। এতে সিলিংয়ের শুরু কোথায়, শেষ কোথায়, সহজে বোঝা যাবে না। ফলে স্পেসটা যত বড়, তার চেয়ে বড় দেখাবে। হালকা রং ব্যবহার করা ভালো। সরাসরি দেয়ালের রং ব্যবহার করতে না চাইলে সেই রঙেরই একটা হালকা শেড ব্যবহার করতে পারেন সিলিংয়ে।
ঘরের আকার–আকৃতি বা ঘরটা কী কাজে ব্যবহার হবে—এসব বিবেচনায় নিয়ে সিলিংয়ে রং আর নকশা করতে হয়। যেমন স্ট্রাইপের প্রতি আপনার ভালোবাসা থাকলে শোবার ঘর, শিশুর ঘর বা স্নানঘরের সিলিং স্ট্রাইপ প্রিন্ট করতে পারেন। তবে সেই একই নকশা রান্নাঘরের সিলিংয়ে বেমানান, এতে রান্নাঘরটা খুবই ছোট আর ঠাসাঠাসি মনে হবে। তবে হলওয়েতে স্ট্রাইপের সিলিং জুতসই। সিলিংয়ে বিভিন্ন ধরনের ওয়ালপেপারও লাগানো যেতে পারে।
মোল্ডিং ও থ্রি–ডাইমেনশনাল ইনস্টলেশন
ঘরের সিলিংয়ে কাটের কারুকার্য বা চুন–বালু দিয়ে আলাদা করে মোল্ডিংও করতে পারেন। হাই–এন্ড প্লাস্টার মোল্ডিং আনতে পারে ভিক্টোরিয়ান মুড। কমপ্লেক্স ডিজাইন লুক বা সিলিংটাকে আর্টিস্টিক লুক দিতে থ্রি–ডি ইনস্টলেশনের দিকে হাত বাড়াতে পারেন। ব্যবহার করতে পারেন টিন, কাঠ বা কাচের সিলিং টাইলস। কী ধরনের টাইলস ব্যবহার করবেন, নির্ভর করবে আপনি কী ধরনের লুক চান, তার ওপর। ভিন্টেজ লুকের জন্য কারুকাজ করা টিনের টাইলসের বিকল্প নেই। মাথার ওপরে সুপার হাই গ্লস, রিফ্লেকটিং ফিনিশিংও আনা সম্ভব। ‘র’ লুক চাইলে সিলিংয়ে ইট বা পাথরের টুকরাও ব্যবহার করতে পারেন। বিভিন্ন ধরনের কাপড় আর ফাইবারও ঝুলিয়ে দিতে পারেন সিলিং থেকে, ঝুলিয়ে দিতে পারেন গাছও। তবে ট্র্যাডিশনাল সিলিং চাইলে আবার কাঠের বিকল্প নেই!
বহুরূপী ফলস সিলিং
সিনথেসিস আর্কিটেক্টস লিমিটেডের সহপ্রতিষ্ঠাতা স্থপতি এ কে এম তানভীর হাসান বলেন, ওয়্যারিং, লাইট, ফ্যান, পর্দা, এসিসহ অন্যান্য সার্ভিস কম্পোনেন্ট ও পাইপ নান্দনিকভাবে আড়াল করা সিলিং–সজ্জার প্রাথমিক কাজ। সিলিং–সজ্জায় অনেক সময় বিম, কলাম আর দেয়ালের বিন্যাস সমতায় থাকে না। তখন সেটাকে দৃষ্টিনন্দনভাবে ফাংশনাল করে ফলস সিলিং। তবে জায়গা বা বাজেট কম থাকলে ফলস সিলিং না লাগানোই ভালো।
প্রতিটি ঘরেই থাকতে পারে কৃত্রিম ছাদ। তবে তার ধরন ভিন্ন হলে ভালো হয়, যাতে ছাদের দিকে তাকিয়েই কোনটা কী ঘর, চেনা যায়। বসার ঘরের সিলিংয়ে চাই জমকালো ভাব। বেডরুমের ছাদজুড়ে থাকা চাই ছিমছাম নকশা আর চোখে আরাম লাগে, এ রকম নরম স্নিগ্ধতা। ডাইনিং টেবিলের ওপরের অংশে লাগাতে পারেন ফলস সিলিং। এতে গুরুত্বপূর্ণ অংশটি আলাদা করা যাবে সহজেই। ফলস সিলিং হতে পারে কাঠ, জিপসাম, পারটেক্স বা কাচের।
ফলস সিলিংয়ে আয়না
সিলিং–সজ্জায় এখন চলছে আয়নার ব্যবহার। মূলত উচ্চতা বেশি দেখাতে বিভিন্ন ধরনের আয়না ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন আকার, আকৃতি আর রঙের মিরর প্যানেল পাওয়া যায়। কেবল সিলিং বদলেই আপনি সাধারণ সাদামাটা একটা খাবার এরিয়াতে আনতে পারেন অভিজাত ভাব।
ফলস সিলিংয়ের লাইটিং
অনেক সময় ফলস সিলিংয়ে পরোক্ষ আলোকসজ্জার (ইনডাইরেক্ট লাইটিং) ব্যবস্থা থাকে। উৎসবে, আয়োজনে নানাভাবে ব্যবহার করতে পারেন সেই আলো। প্রয়োজন অনুসারে হিডেন লাইট, স্পটলাইট, টিউব লাইট বা ফলস লাইটের আলো-আঁধারিতে ঢাকা দৃষ্টিনন্দন সিলিং বদলে দিতে পারে অন্দরের আবহ। ঘরের মেঝেতে যদি থাকে রিফ্লেক্টিং টাইলস, তবে আলো-আঁধারির এই খেলা আরও জমে উঠবে। কিছু লাইট আছে, যা সরাসরি মেঝেতে এসে পড়বে কিন্তু ওপরের অংশ থাকবে তুলনামূলক অন্ধকার। আবার রিফিউজ লাইট ছাদকে আলোকিত করলেও ঘরজুড়ে খেলা করবে আলো–ছায়া। ঘরের কোন জায়গায় বেশি আলো পড়বে আর কোন জায়গায় কম, তা সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন ফলস সিলিংয়ের সাহায্যে। চাইলে কোনো শোপিস, আর্টপিস অথবা ভাস্কর্যকে ফোকাস করেও ফলস সিলিং থেকে লাইটিং করা যায়।
জিপসামের ফলস সিলিং
এ ধরনের সিলিংয়ে যে উপাদান ব্যবহার করা হয়, তা ঠান্ডা বাতাস ঘরে আটকে রেখে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে।
স্থপতি কৌশিক কুমার মজুমদারের মতে, সিলিং যতটা সাদামাটা রাখা যায়, ততই ভালো। বাড়ি মানে একটা মিলনস্থল, যেখানে পরিবারের সবাই একসঙ্গে গল্প করেন, অনুভূতি ভাগাভাগি করে নেন, শিশুরা বেড়ে ওঠে, একই সঙ্গে একটা বাড়ি বাসিন্দাদের জন্য ব্যক্তিগত জায়গাও বটে। তাই সিলিং এমনভাবে নকশা করতে হবে, যাতে বাড়ির মূল ভাবনাটা যেন বাধাগ্রস্ত না হয়। দেশের তাপমাত্রার সঙ্গে মিল রেখে সিলিং এমন হওয়া উচিত, যাতে গরম বাতাসটা বের হয়ে যেতে পারে। শিশুর ঘরের সিলিং হতে পারে রঙিন, এতে তাদের কল্পনাশক্তি বাড়ে।
সিলিং–সজ্জায় সতর্কতা
১. সিলিংয়ে ব্যবহৃত উপাদানগুলো যেন অদাহ্য হয়।
২. কাচের সিলিং ব্যবহার করার ক্ষেত্রে সেটা যাতে নিরাপদ হয়, সেই ভার রাখার মতো বিম–কলাম নিশ্চিত করতে হবে।
৩. অপ্রয়োজনীয়, অনিরাপদ, ভারী সিলিং–সজ্জা হতে পারে মানসিক চাপ আর বিপদের কারণ।
৪. সিলিংয়ে নানা কিছু করতে গিয়ে ইলেকট্রিক লাইনগুলোর নিরাপত্তা কোথাও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে কি না, সেটিও খেয়াল রাখতে হবে।
লেখক: সাইফুর রহমান, স্থপতি