বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কার: ভিনদেশে পড়ছেন যাঁরা, তাঁরা কী বলছেন

ছবি: লতিফ হোসাইন/এআই আর্ট

সর্বস্তরেই এখন সংস্কারের রব। এ সুযোগে দেশের উচ্চশিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে প্রবাসী শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আক্ষেপগুলো আমরা শুনতে চেয়েছিলাম। চীন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ নানা দেশে বাংলাদেশিরা পড়েন, পড়ান। ভিনদেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে কোন কোন নিয়ম বা রীতি তাঁদের আকৃষ্ট করেছে, কোনগুলো বাংলাদেশেও থাকা উচিত বলে তাঁরা মনে করেন?

চলুক ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জন

তত্ত্বীয় শিক্ষা ও হাতে–কলমে প্রশিক্ষণ—দুটির সমন্বয়ে সাজানো হয় ইউরোপীয় দেশগুলোর পাঠ্যক্রম। অর্থাৎ নির্দিষ্ট কিছু প্রোগ্রামে পড়ালেখার পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে শিক্ষানবিশি কিংবা কাজের সুযোগ পান। বাংলাদেশেও এ ধরনের প্রোগ্রাম থাকা উচিত, মনে করেন জার্মানির টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি অব ডার্মস্টাডের শিক্ষার্থী আহমেদ শাকিল। তিনি জানালেন, জার্মানিতে নয়টি প্রযুক্তিসংক্রান্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অ্যালায়েন্স আছে, যাকে বলা হয় ‘টিইউ নাইন’। এই টিইউ নাইন জার্মান সরকারকে পরামর্শ দেয়। তাদের পরামর্শের ভিত্তিতে বিভিন্ন বিষয়ে চার বছর পরপর শিক্ষাকাঠামো হালনাগাদ করা হয়। অনেক বিষয় বন্ধ করে দেওয়া হয়, চালু করা হয় নতুন নতুন বিষয়। সম্প্রতি যেমন দুটি বিষয় বন্ধ করে তিনটি বিষয় নতুন চালু করা হয়েছে।

লুৎফুন্নাহার রাসনাও ব্যবহারিক শিক্ষার ওপর জোর দিলেন। জার্মানির ইউনিভার্সিটি অব বনে প্ল্যান্ট সায়েন্সে পড়ছেন তিনি। রাসনা বলেন, ‘বাংলাদেশের অনার্স-মাস্টার্সের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন যন্ত্র ও এর কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে লিখিত সবকিছুই জানেন। কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই যন্ত্রটি আদতে আমরা দেখার সুযোগ পাই না। আমি এখন যেখানে পড়ছি, সেখানে শিক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলকভাবে কিছু সেমিনারে অংশ নিতে হয়। যেখানে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ডিজিটাল প্রেজেন্টেশন থাকে, সেসব নিয়ে আলোচনা হয়। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাস বাড়ে।’

শিক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছতা

কোরিয়ার সরকারি বৃত্তি নিয়ে সে দেশে স্নাতক করেছেন অতনু চক্রবর্ত্তী। এখন যুক্তরাষ্ট্রের অবার্ন ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স করছেন। বলছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক কাঠামোতে প্রতিটি ফ্যাকাল্টি, ডিন যথেষ্ট স্বাধীন। এখানে শিক্ষক নিয়োগপ্রক্রিয়া যে পরিমাণ স্বচ্ছ ও কঠিন, বাংলাদেশেও তেমনটা থাকা উচিত। আমাদের দেশের অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে ঢুকলে মনে হয় সরকারি দলের ওয়েবসাইট। অথচ ওয়েবসাইট তো আরও পেশাদার হওয়া উচিত, যেন ঢুকলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা কার্যক্রম সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়।’

গবেষণামুখী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিকাশ

কয়েক বছর হয় দেশের সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণায় জোর দিতে চেষ্টা করছে। কীভাবে এই চেষ্টা আরও বেগবান করা যায়? যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাল্টিডিসিপ্লিনারি জেন্ডার স্টাডিজে এমফিল করা সারাহ আরজুমান চৌধুরী বলেন, ‘বিভিন্ন বিষয়ে আলোচিত বিজ্ঞানী ও পেশাজীবীদের অতিথি শিক্ষক হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো একটা খুব কার্যকর উপায়। এতে শিক্ষার্থীরা গবেষণার আইডিয়া পান। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, পশ্চিমা দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অনলাইন রিসোর্স হাব উন্মুক্ত। ফলে এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইন লাইব্রেরি বা জার্নাল পড়ার সুযোগ থাকে। এটি বেশ কার্যকর। বাংলাদেশেও এই সুবিধা থাকা উচিত।’

যুক্তরাষ্ট্রের টাফটস ইউনিভার্সিটির কোয়ান্টিটেটিভ ইকোনমিকস ও গণিতের শিক্ষার্থী জাহির ইসলাম বলেন, ‘আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের লেইড-ল স্কলার্স লিডারশিপ ও রিসার্চ প্রোগ্রামে অক্সফোর্ড-কেমব্রিজসহ বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় আরও বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় যুক্ত আছে। দুটি সামারজুড়ে হয় এই প্রোগ্রাম। প্রথম সামারে আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষকের অধীনে ছয় সপ্তাহের একটি গবেষণা করবেন। পরের সামারে ছয় সপ্তাহের জন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে কাজ করবেন, যেখানে আপনার গবেষণাটি প্রয়োগের সুযোগ থাকবে। এ ধরনের প্রোগ্রাম নিয়ে বাংলাদেশেরও ভাবা উচিত।’

রাজনীতি নয়, রাজনৈতিক মনস্কতা

চীনের শিদিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স ইন ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ছেন মো. ফোরকান। তিনি বলেন, ‘চীনে কমিউনিস্ট পার্টির একক প্রভাব থাকা সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে দৃশ্যমান কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি দেখা যায় না। নেই কোনো লেজুড়বৃত্তিক দলীয় চর্চা কিংবা মিছিল, মিটিং, সমাবেশ। ক্যাম্পাসগুলোতে কোথাও কোনো রাজনৈতিক ব্যানার বা ফেস্টুনও চোখে পড়েনি। এখানে শিক্ষার্থীদের মধ্যে রাজনৈতিক চর্চা বলতে “সেমিনার” বোঝায়। দেশের কমিউনিস্ট নেতারা ক্যাম্পাসে আমন্ত্রিত হয়ে আসেন। শিক্ষার্থীরা তাঁদের লেকচারের ওপর আলোচনা-সমালোচনা করেন। প্রচলিত ধারা থেকে বের হয়ে এ ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনৈতিক চর্চা বাংলাদেশেও শুরু করা যেতে পারে।’

আরও ৫ প্রত্যাশা

প্রবাসী শিক্ষার্থীরা আরও বেশ কিছু বিষয়ে তাঁদের প্রত্যাশার কথা জানালেন। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি-

১. শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য ও কাউন্সেলিং সেবাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া দরকার। এই সেবা শুধু নামমাত্র না হয়ে সত্যিকার অর্থেই কার্যকর হওয়া উচিত।

২. ভিনদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘প্রবলেম সলভিং’ বা সমস্যা সমাধানের দক্ষতার ওপর বেশ গুরুত্ব দেওয়া হয়। এই চর্চাও গড়ে তোলা দরকার।

৩. দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ‘শিক্ষক মূল্যায়ন’ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। যেন শিক্ষার্থীরা নিজের পরিচয় প্রকাশ না করেও শিক্ষক ও কোর্স সম্পর্কে তাঁর মতামত জানাতে পারেন।

৪. চীনসহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যক্রম এমনভাবে সাজানো, আপনি যে বিষয়েই পড়েন না কেন, গবেষণা আপনাকে করতেই হবে। গবেষণার বিভিন্ন টুল ও পদ্ধতি সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের যদি যথাযথ ধারণা দেওয়া যায়, তাহলে বাংলাদেশেও এমনটা করা সম্ভব।

৫. ফলাফল প্রকাশ থেকে শুরু করে সনদের আবেদন গ্রহণ—সব কার্যক্রম অনলাইনের মাধ্যমে করার সুযোগ থাকা উচিত। যেন ‘লাঞ্চের পর আসেন’ সংস্কৃতি জায়গা করে নিতে না পারে।