বছরজুড়ে মানুষের সাফল্য আর সাধারণের অসাধারণ গল্প হাজির করেছে ‘ছুটির দিনে’
মানুষের সাফল্য, ব্যতিক্রমী উদ্যোগ, সাধারণের অসাধারণ গল্পই ছাপা হয় ‘ছুটির দিনে’তে। ২০২৪ সালেও এমন অনেক মানুষকে হাজির করে এই ক্রোড়পত্র।
মির্জা আনোয়ার হোসেনের মুখে যে হাসি ফুটে উঠেছে, মুঠোফোনের এ প্রান্ত থেকেই বুঝতে পারছিলাম। পেশায় তিনি একজন দরজি। খুলনার কয়রায় ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে জাতীয় পতাকা তৈরি করে চলেছেন। এ কাজ করে দিনে দিনে এলাকায় পরিচিতি পেয়েছেন ‘পতাকা চাচা’ হিসেবে। ৭০ ছুঁই ছুঁই মানুষটার জীবনের গল্প ছাপা হয়েছিল ৭ ডিসেম্বর। সেই সূত্র ধরেই ফোনে বলছিলেন, ‘পেপারে আমাকে নিয়ে কোনো দিন লেখা হবে, স্বপ্নেও ভাবিনি। নিজের ছবি দেখে খুব আনন্দ পেয়েছি।’
বছরজুড়ে মানুষের এমন আনন্দের উপলক্ষ হওয়ার চেষ্টাই করে গেছে ‘ছুটির দিনে’। মানুষের সাফল্য থেকে সাধারণ মানুষের অসাধারণ জীবনের গল্প প্রকাশ করে গেছে। এই যেমন লালমনিরহাট সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক তৌহিদ-উল ইসলাম। ‘আইপিডিসি-প্রথম আলো প্রিয় শিক্ষক সম্মাননা’ পেয়েছিলেন তিনি। সম্মাননার অর্থ দিয়ে নিজ বাড়িতে গড়ে তুলেছেন ‘বঙ্গভাষা লেখক জাদুঘর’। কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ীতে সেই জাদুঘর এখন আলো ছড়াচ্ছে।
এবার আন্তর্জাতিক নারী দিবসে ব্যতিক্রমী এক উদ্যোগ নিয়েছিল বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। একটি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনার সব দায়িত্বই নারীদের দেয় এই সরকারি সংস্থা। ঢাকা–দাম্মামগামী বিজি-৩৪৯ ফ্লাইটটির গ্রাউন্ড থেকে ককপিট—সব বিভাগের দায়িত্বই সাফল্যের সঙ্গে পালন করেন তাঁরা। সেই সময় ছুটির দিনের পাঠকদের ফ্লাইটটির অভিজ্ঞতা শুনিয়েছিলেন বিমানের ফার্স্ট অফিসার ফারিহা তাবাসসুম।
প্রবাসী বাংলাদেশিদের সাফল্যগাথাও উঠে এসেছে ছুটির দিনের পাতায়। তাঁদেরই একজন অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী সায়েদ আহমেদ। আলসারের উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা ডায়াবেটিক রোগীদের পা দেখে জুতা তৈরির ব্যবস্থাপত্র দেন সায়েদ। পায়ের স্বাস্থ্যের এ বিষয় নিয়েই পিএইচডি করেছেন। ড. সায়েদের পেডোরথিস্ট বা পদস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠার গল্প পড়ে দেশে অনেক মানুষই প্রথম আলোর সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
অস্ট্রেলিয়ারই আরেক খ্যাতিমান মানুষ ওপেল খান। দেশটিতে ৫৩ রেস্তোরাঁর অংশীদার বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ওপেল একজন রন্ধনশিল্পী। ফরাসি খাবারের পদে নতুনত্ব এনে অস্ট্রেলিয়ায় পরিচিতি পেয়েছেন তিনি। এবার বাংলাদেশি খাবারকে সে দেশে জনপ্রিয় করতে চালু করেছেন নতুন এক রেস্তোরাঁ।
শাকিল রেজার গল্পটাও অনুপ্রেরণার। তুরস্কের ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তি নিয়ে স্নাতক পড়তে গিয়েছিলেন দিনাজপুরের শাকিল। দ্বিতীয় বর্ষে ওঠার পর জটিল এক রোগে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। অস্ত্রোপচারের পর হাসপাতালে কাটে মাসের পর মাস, প্রাণে বাঁচলেও হারালেন চলনশক্তি। কিন্তু থেমে যাননি শাকিল। ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। হুইলচেয়ার সঙ্গী করে এখন তিনি চাকরি করেছেন ইস্তাম্বুলে। নিজের জীবনের অসহায় মুহূর্তের গল্প বই আকারে প্রকাশও করেছেন। এবার বাংলাদেশে এলে নিজের জীবনের গল্প ছুটির দিনের পাঠকদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেন শাকিল।
বর্ষা ইসলামের জীবনের গল্পও পাঠককে অনুপ্রাণিত করেছে। বর্ষা আর তাঁর স্বামী মোহাম্মদ রাফি মিলে দুর্গম সব গন্তব্যে ট্যুর পরিচালনা করতেন। ২০২৩ সালের আগস্টে গহিন পাহাড়ে এমনই এক ভ্রমণ-অভিযানে গিয়ে মারা যান রাফি। জীবনসঙ্গীকে হারিয়ে অকূলপাথারে পড়েন বর্ষা। তবে থেমে যাননি। রাফির দেখানো পথ ধরে এক বছরের মাথায়ই আবার কীভাবে ঘুরে দাঁড়ালেন, সেই গল্পই শুনিয়েছিলেন বর্ষা ইসলাম।
এই দুই তরুণের তুলনায় মোহাম্মদ রেদওয়ানের গল্পটা আলাদা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মোহাম্মদ রেদওয়ানের পরিচয় ‘হৃদয় দ্য সেইলর’। সমুদ্রজীবনের নানা বিষয় নিয়ে ভিডিও তৈরি করেন এই নাবিক। ফেসবুক, ইউটিউব ও টিকটকে তাঁর বানানো ভিডিও দেখেন লাখ লাখ মানুষ। তাঁর কনটেন্ট ক্রিয়েটর–জীবনের গল্প অনেককে অনুপ্রাণিত করে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হইচইয়ের যুগে নিভৃতে কাজ করে চলেছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুরের তরুণ মাহির ইয়াসির। তাঁর সংগ্রহ নিয়ে গবেষণা করেই একদল প্রত্নতাত্ত্বিক রহনপুরে দুই থেকে আড়াই হাজার বছর আগের একটি বাণিজ্যকেন্দ্র ও বসতির খোঁজ পেয়েছেন। ছুটির দিনেতে প্রতিবেদন প্রকাশের পর মাহির আরও বেশি করে প্রত্নতত্ত্বের সন্ধানে মনোযোগী হয়েছেন।
প্রাণপ্রকৃতি নিয়ে গবেষণায় নিরন্তর কাজ করে চলেন বাংলাদেশের তরুণেরা। ব্যতিক্রমী গবেষণার বিষয় নিয়ে সাফল্যও পেয়েছেন। যেমন বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে গেলে গোটা পৃথিবী থেকেই ‘নাই’ হয়ে যেতে পারে পাখির দুটি প্রজাতি—চামচঠুঁটো বাটান আর সুন্দরী হাঁস। বছরের পর বছর এই পাখি দুটি নিয়ে কাজ করছেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডিরত সায়েম ইউ চৌধুরী। ওদিকে শিম্পাঞ্জি নিয়ে গবেষণা করতে এখন রুয়ান্ডার গহিন বনে রয়েছেন বাংলাদেশের হাসান আল-রাজী। ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ায় পিএইচডি গবেষণা করছেন তিনি। শিম্পাঞ্জিদের সঙ্গেই এখন কাটে তাঁর মাসের অর্ধেকটা। এই গবেষকের ‘বনবাস’–জীবনের গল্প যেমন ছুটির দিনে ছেপেছে, তেমনি সায়েম ইউ চৌধুরীর পাখি জীবনযাপন নিয়ে গবেষণার চমকপ্রদ গল্পও হাজির করেছে।
২০২৪ সালের মতো নতুন বছরেও মানুষের জীবনের নতুন নতুন গল্প নিয়ে হাজির হবে ছুটির দিনে।