বিজ্ঞানীরা আমাকে এতটা মূল্যায়ন করবে ভাবিনি
শিক্ষাগত যোগ্যতার কোনো সনদ নেই, তবে আছে নতুন নতুন ধান উদ্ভাবনের কৃতিত্ব। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরাও আমলে নিয়েছে তাঁর কাজ। কৃষক-বিজ্ঞানী সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়ে এ মাসেই ঘুরে এলেন মালয়েশিয়া। আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদকে সেই অভিজ্ঞতাই শোনালেন স্বশিক্ষিত কৃষিবিজ্ঞানী নূর মোহাম্মদ
রাজশাহীর তানোর উপজেলার গোল্লাপাড়া গ্রামে আমার বাড়ি। আমার তিন বছর বয়সে মা মারা যান। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় মারা যান বাবা। আমাকে মানুষ করেছে আমার নানি। বুদ্ধি হওয়ার পর নানির দেওয়া খেতেই ধান চাষ শুরু করি। এখনো সেই ধান নিয়েই আছি।
ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি, আমাদের এলাকায় প্রায় প্রতিবছরই খরায় ধান নষ্ট হয়। সেই ধান রক্ষা করতেই ২০ বছর আগে নিজে নিজে গবেষণা শুরু করি। দিনে দিনে আমার মাটির ঘরটাই হয়ে ওঠে গবেষণাগার। পরে (ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান) হেলাল উদ্দিন স্যারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা পেলাম। হাতে-কলমে অনেক কিছু শিখলাম। এ পর্যন্ত সংকরায়ণের পর আমার কৌলিক সারির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০০। এর মধ্যে পাঁচটি সারি জাত হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য। এসব নিয়েই ব্যস্ত থাকি।
ধান নিয়ে কাজের জন্য দেশে স্বীকৃতি-সম্মানও পেয়েছি। কিন্তু কোনো দিন বিদেশ থেকে আমন্ত্রণ পাব ভাবিনি। এবার তা–ও হলো। আমার মতো মানুষকে মালয়েশিয়ায় কৃষক-বিজ্ঞানী সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো হলো। ৬ থেকে ৯ নভেম্বর মালয়েশিয়ার পেনাং শহরে হবে এই সম্মেলন। সম্মেলনে যেতে আমাকে সহযোগিতা করতে এগিয়ে এল গবেষণা উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইনডিজিনাস নলেজ (বারসিক)।
এই প্রথম দেশের বাইরে যাচ্ছি। ভেতরে অন্য রকম একটা উত্তেজনা। ৪ নভেম্বর রাতে ঢাকায় বিমানবন্দরে পৌঁছালাম। সেখানে একটা অন্য রকম অভিজ্ঞতা হলো। আমি তো কিছুই চিনি না। আমার ভরসা (বারসিকের অ্যাগ্রো-ইকোলজি ও ফুড সিকিউরিটি ইউনিটের পরিচালক) এ বি এম তৌহিদুল আলম। ইমিগ্রেশনে আমার কোনো সমস্যা হলে যাতে দেখতে পারেন, তার জন্য আমাকে সামনে দিলেন। কাগজপত্র দেখে ইমিগ্রেশনের একজন কর্মকর্তা আমাকে নিয়ে চলে গেলেন আরেক বড় কর্মকর্তার কাছে। তাঁরা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যে আমি কৃষক-বিজ্ঞানী। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মালয়েশিয়ায় সম্মেলনের আমন্ত্রণ পেয়েছি।
সব কাগজপত্র দেখার পর একজন পুলিশ ফোন নম্বর দিয়ে বললেন, ‘আপনার উদ্ভাবিত ধানের চাল পাঠাবেন।’ তারপর আমাকে ছেড়ে দিলেন।
আমি তো এদিকে তৌহিদুল আলমকে হারিয়ে ফেলেছি। তিনিও হয়তো আমার কোনো সমস্যা হয়েছে মনে করে টেনশনে পড়েছিলেন। একসময় খুঁজতে খুঁজতে সেই কর্মকর্তার কক্ষে এলেন।
পরে আর কোনো সমস্যা হয়নি।
আমি একজন খাদ্যযোদ্ধা
এই প্রথম বিমানে ওঠা। সবকিছু স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিল। ঢাকা থেকে প্রথমে সিঙ্গাপুর। তারপর আরেকটি ফ্লাইটে মালয়েশিয়া।
বিমানবন্দরেই আমাদের নেওয়ার জন্য গাড়ি ছিল। সোজা হোটেলে নিয়ে গেল। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি বাইরে সমুদ্র। জাহাজ ভাসছে। কী যে মনোরম দৃশ্য!
৬ নভেম্বর থেকে সম্মেলন শুরু হলো। বিরাট সম্মেলনকক্ষে বারসিকের পক্ষ থেকে আগেই আমার ১১টি ছবি দেয়ালে টাঙানো হয়েছে। বিজ্ঞানীরা যাঁর যাঁর বক্তব্য উপস্থাপন করলেন। তারপর এল আমার পালা। সাহস করে বললাম, আমি একজন খাদ্যযোদ্ধা। করোনার সময় অধিক ফসল উৎপাদন করেছি। উৎপাদন বৃদ্ধির স্বার্থে বহু জাতের ধানের বীজ মিশ্রণ করে উদ্ভাবন করা হয় উন্নত জাত। দীর্ঘদিন সংকরায়ণ ও বাছাইকরণের মাধ্যমে ধানের আউশ, আমন ও বোরো মৌসুমের কৌলিক সারি উদ্ভাবন করি। এই সারিগুলোর গাছ বেশ মজবুত। সহজে হেলে পড়ে না। রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ অন্যান্য গাছের তুলনায় অনেক কম। স্বল্প জীবনকাল। উচ্চ ফলন। সরু, চিকন, সুগন্ধি, খরাসহিষ্ণু, লাল চাল, কালো চালসহ নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে কাজ করে যাচ্ছি। দেশি ধানের উন্নয়ন ঘটিয়ে কোনোটার জীবনকাল কমিয়ে বাড়ানো হয়েছে ফলন। খরাপীড়িত বরেন্দ্র অঞ্চলে কম পানিতে কম সময়ে কম খরচে ফলানো যায়, এমন ধান নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম চলমান রয়েছে। নতুন নতুন, উন্নত ও উচ্চ ফলনশীল ধান উদ্ভাবন করে সারা দেশের কৃষকদের পৌঁছে দিই।
তৌহিদুল আলম আমার বক্তব্য অনুবাদ করে দিলেন, অন্যদের কথা বুঝতে আমাকে সহযোগিতা করলেন।
সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ১৭ দেশের শতাধিক প্রতিনিধি। ভাবতে পারিনি ভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা এতটা মূল্যায়ন আমাকে করবেন। তাঁদের কাছে আমি যেন বিস্ময়কর এক মানুষ। বিক্রির জন্য চারটি ও বিজ্ঞানীদের উপহার দেওয়ার জন্য নিজের উদ্ভাবিত ২০ জাতের ধানের চাল নিয়ে গিয়েছিলাম। উপহার পেয়ে তাঁরা ভীষণ খুশি। সবাই আমার সঙ্গে ছবি তোলার জন্য ব্যগ্র। নারীরাও কোনো সংকোচ করছেন না।
মালয়েশিয়ার সাবাহ রাজ্যের এক কিষানির কাছ থেকে একটি ধানের জাত নিলাম। ওখানে খরাপীড়িত পাহাড়ি এলাকায় এই ধান হতে সময় লাগে ছয় মাস। আশা করছি, গবেষণা করে এই ধানের জীবনকাল কমিয়ে আনতে পারব।