প্রকৌশলী ভিকি কৌশল যেভাবে অভিনেতা হলেন

ভারতীয় অভিনেতা ভিকি কৌশল। অভিনয় করে পেয়েছেন জাতীয় পুরস্কার, ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডসহ বেশ কিছু স্বীকৃতি। মুম্বাইয়ের উষা প্রবীণ গান্ধী কলেজ অব ম্যানেজমেন্টে আয়োজিত লিটফেস্টে অতিথি হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। শুনিয়েছেন অভিনয়ের জগতে পা রাখার গল্প।

ভিকি কৌশল
ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে নেওয়া

প্রকৌশলের পাঠ আমার ভেতরের জোয়ানটাকে জাগিয়েছে/ স্যার, ৫-৬ বছরের মধ্যে হলের সামনে আমার পোস্টার দেখতে পাবেন

আমি ছিলাম (মুম্বাইয়ের) মিঠিবাই কলেজের ছাত্র। তোমাদের ক্যাম্পাসের সামনের বাসস্টপ থেকেই প্রতিদিন বাসে উঠতাম। বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম। প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত ক্লাস থাকত। ৭৯,৩৩ আর ৩৮ নম্বর বাস—এই তিনটাই আমার বাড়ির পথে যেত।

আচ্ছা, এখন এখানকার বড়া পাওয়ের দাম কত?

কী বললে? ২০ রুপি! মিঠিবাইতে আমি যখন পড়ি, ২০০১ থেকে ২০০৩ সাল, তখন দাম ছিল ৫ রুপি। শেষের দিকে অবশ্য মাখন মাখানোর কারণে ৬ রুপি নিত। সে সময় আমার মাসিক হাতখরচ ছিল ৬০০ রুপি। অর্থাৎ, প্রতিদিনের জন্য বরাদ্দ ২০ রুপি। লোখন্ডওয়ালা থেকে বাসে আসা-যাওয়ার খরচ ১০ রুপি, ৫ রুপিতে বড়া পাও, বাকি ৫ রুপি আমি জমিয়ে রাখতাম; যেন দুই সপ্তাহ পর একটা সিনেমা দেখতে পারি।

প্রকৌশলে পড়েছিলাম রাজীব গান্ধী ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে। আমি সব সময় বর্তমানে বিশ্বাসী। তখন জীবন নিয়ে কোনো পরিকল্পনাই ছিল না। প্রকৌশলী হতে হবে, অভিনেতা হতে হবে—কিচ্ছু মাথায় ছিল না। তখন আমার কাজ ছিল পড়ালেখা করা, আমি পড়ালেখা করেছি। মজা করার সময় মজা করেছি।

ভিকি কৌশল

এরপর কী করবে?—এই প্রশ্নের উত্তরে সবার দেখাদেখি আমিও বলতাম, ‘এমবিএ করব।’ যখন সবাই ‘জিআরই’ বলা শুরু করল, আমি তা-ই করলাম। সহজ কথায় আমার একমাত্র ভাবনা ছিল স্নাতকোত্তর করা। ক্যারিয়ার নিয়ে তখনো ভাবিনি। পড়ালেখায় ভালো ছিলাম। মঞ্চেও খুব সক্রিয় ভূমিকা রাখতাম। ভেতরে-ভেতরে মঞ্চের কাজ আমার ভালো লাগত। কিন্তু তখন পর্যন্ত এটা শুধু শখই ছিল। অভিনয়ও যে একটা পেশা হতে পারে, মাথায়ই আসেনি।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

এ জীবনই কি আমি চাই?

দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমাদের ‘ইন্ডাস্ট্রি ভিজিট’-এ নিয়ে যাওয়া হলো। শিক্ষকেরা আমাদের দেখাতে চেয়েছিলেন, ‘বাচ্চারা, এই হলো তোমাদের ভবিষ্যৎ। দেখো, বহুজাতিক কোম্পানি দেখতে কেমন, কীভাবে তাঁরা কাজ করে।’ সেদিনই প্রথমবারের মতো আমি একটা ধাক্কা খেলাম। মনে মনে বললাম, এই জীবন তো আমার জন্য নয়। এমন ভবিষ্যৎ তো আমি চাই না।

সে সময় প্রথমবারের মতো নিজেকে প্রশ্ন করি, একটা অফিস-চেয়ারে যদি বসতে না-ই চাই, তাহলে আমি চাই কী? কী করতে আমি ভালোবাসি? উত্তর পাই, অভিনয়। আয়নায় নিজেকে আপাদমস্তক দেখে খুব একটা ভরসা পাইনি। কিন্তু মনে হলো, এ ছাড়া আর পথ কী। দেখা যাক!

আমাদের বাড়ির অলিখিত নিয়ম ছিল, যা-ই করো, আগে পড়ালেখা শেষ করতে হবে। সত্যি বলতে, প্রকৌশল বিষয়টার প্রতি আমার একটা আলাদা টান আছে। ভবিষ্যতে আমার সন্তান কী করবে জানি না, কিন্তু আমি ওকে প্রকৌশলেই পড়তে বলব। কারণ, এ বিষয়ে পড়তে গিয়েই আমি আমার সেরা বন্ধুদের পেয়েছি। প্রকৌশলে পা রাখার আগে আমিও সেই লাজুক, নিজের মধ্যে গুটিয়ে থাকা ছেলেটাই ছিলাম। প্রকৌশলের পাঠ আমার ভেতরের জোয়ানটাকে জাগিয়েছে। কারণ অ্যাসাইনমেন্ট, প্রজেক্ট, পরীক্ষা…এগুলো যা দেয়, তা শিক্ষার চেয়েও বেশি কিছু।

অভিনয়ের শুরু

প্রকৌশলের পাঠ শেষ করে ২০০৯ সালে আমি অভিনেতা হিসেবে যাত্রা শুরু করি। এটা ঠিক যে আমি অভিনয় শিখতে চেয়েছি, দক্ষতা অর্জন করতে চেয়েছি। কিন্তু আমার কাছে তার চেয়েও বড় প্রশ্ন ছিল, যদি জীবনের প্রতিটি দিন এ কাজটাই করতে হয়, তাহলে আমি কি একজন সুখী মানুষ হব, নাকি ভেতরে-ভেতরে কুঁকড়ে থাকব?

তখন মাত্রই ২২ বছর বয়স। ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর কোনো তাড়া আমার ছিল না। ক্যামেরায় সব ধরা পড়ে। ভালো অভিনয়, দুর্দান্ত অভিনয়, খারাপ অভিনয়, একদম বাজে অভিনয়—সব! আপনি অভিনয় জানেন, নাকি জানেন না, সেটা প্রথম দৃশ্যের প্রথম শটেই দর্শকের আসনে বসা মানুষটি বুঝে ফেলেন। একবার যদি তাঁরা মুখ ফিরিয়ে নেন, তখন নিজেকে প্রমাণ করা খুব কঠিন। অতএব দর্শকের সামনে দাঁড়ানোর আগেই আমি পুরো প্রস্তুতিটা সেরে নিতে চেয়েছিলাম।

মনে মনে আমি নিজেকে পাঁচ বছর সময় দিয়েছিলাম। ঠিক করেছিলাম, এই পাঁচ বছরে আমি যতভাবে সম্ভব শিখব। মঞ্চের পেছনে কাজ করব, পরিচালকের সহকারী হব, যা পাব তা-ই করব। কিন্তু শিখব।

আমি অভিনয়ের কোর্স শুরু করেছিলাম ২০০৯ সালের ২৪ জুলাই। প্রথম ক্লাসে আলোচনা হচ্ছিল, জীবনের বিগত পাঁচ বছর কে কীভাবে কাটিয়েছে, সামনের পাঁচ বছরে কে কোথায় পৌঁছাতে চায়। আগেই বলেছি, আমার এসব প্রশ্ন পছন্দ না। পরের ৫ মিনিটে কী করব তা-ই জানি না, পাঁচ বছরের কথা বলি কী করে! কখনো কখনো দেখা যায়, পাঁচ বছর পর আমি নিজেকে যেখানে দেখতে চাই বলে ভাবছি, সৃষ্টিকর্তা তার চেয়ে অনেক বড় পরিকল্পনা নিয়ে বসে আছেন। অতএব এসব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে আমি চিন্তার জগতে কোনো সীমানা তুলে দিতে চাই না।

কিন্তু ক্লাসভর্তি লোকের সামনে তো আর বলতে পারি না যে প্রশ্নটা আমার পছন্দ হয়নি। তাই উত্তর দিয়েছিলাম, ‘স্যার, পাঁচ কি ছয় বছরের মধ্যে আপনি সিনেমা হলের সামনে আমার পোস্টার দেখতে পাবেন।’

মজার ব্যাপার হলো, ২০১৫ সালের ২৪ জুলাই মাসান মুক্তি পায়। এ ধরনের ঘটনা আমাদের ‘বিশ্বাস’-এর ওপর বিশ্বাস রাখতে শেখায়। কীভাবে হবে, সেটা জানা জরুরি নয়। কিন্তু হবে, এটা বিশ্বাস করা জরুরি। (সংক্ষেপিত)

ইংরেজি থেকে অনুদিত