ব্রোঞ্জ জয়ের অভিজ্ঞতা

যুক্তরাজ্যের বাথ শহরে বসেছিল আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের ৬৫তম আসর। ২১ জুলাই ঘোষিত হয় ফলাফল। এ বছর বাংলাদেশের জন্য ব্রোঞ্জ এনেছেন গণিত দলের দুই শিক্ষার্থী—ঢাকা কলেজের এস এম এ নাহিয়ান ও ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের মনামী জামান। পড়ুন তাঁদের অভিজ্ঞতা

ঢাকা কলেজের এস এম এ নাহিয়ান ও ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের মনামী জামানছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

প্রথম আলো থেকে জেনেছি পদক জয়ের খবর

এস এম এ নাহিয়ান
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

এস এম এ নাহিয়ান, ঢাকা কলেজ

এ বছর আমি উচ্চমাধ্যমিক দিচ্ছি। দুটি পরীক্ষার মাঝখানে একটি ছোট বিরতি পেয়েছিলাম। সেই বিরতিতেই ছুটে যাই যুক্তরাজ্যে। তখনো জানতাম না, অনির্দিষ্টকালের জন্য আমাদের পরীক্ষাগুলো পিছিয়ে যাবে।

প্রায় ১৪ ঘণ্টার বিমানযাত্রা, ট্রানজিটের ধকল কাটিয়ে যতটা সম্ভব ফুরফুরে মেজাজে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের চেষ্টা করেছি। দলের সঙ্গে নয়, আমি যুক্তরাজ্যে হাজির হয়েছিলাম আলাদা। তাই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে থাকতে পারিনি। এবার নিয়ে তৃতীয়বার বাংলাদেশ দলের সদস্য হিসেবে আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে যাওয়ার সুযোগ হলো। বাংলাদেশের পতাকা হাতে, পতাকার রঙের টি–শার্ট পরে সবার সঙ্গে মঞ্চে ওঠার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছি বলে একটু মন খারাপ হচ্ছিল। তবে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মঞ্চে অন্যদের ছবি দেখে মন ভালো হয়ে গেছে।

ইউনিভার্সিটি অব বাথে এবারের পরীক্ষার আয়োজন করা হয়। আমার সঙ্গে আরও ছিল ১০৮ দেশের ৬০০ জনের বেশি শিক্ষার্থী। আমাদের পরীক্ষা হয় ১৬ ও ১৭ জুলাই। ২৩ নম্বর নিয়ে ব্রোঞ্জপদক পেয়েছিলাম গত বছর। এবার লক্ষ্য ছিল নম্বর বাড়ানো। প্রস্তুতিও ভালো নিয়েছিলাম। কিন্তু দীর্ঘ ভ্রমণের পর মনোযোগ ধরে রাখাটা কঠিন হয়ে পড়ে।

দুই দিনের নয় ঘণ্টার পরীক্ষায় মনোযোগটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম দিনের পরীক্ষা শেষে অন্য দেশের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপের সুযোগ পাই। মিয়ানমার, সাইপ্রাস, বেলজিয়ামসহ বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে। দ্বিতীয় দিনের পরীক্ষা শেষ করেই দেশে চলে আসি, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা ছিল বলে।

দেশে পৌঁছে দেখি ইন্টারনেট নেই। ফলে অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। অনলাইনে যে ফলাফল দেখব, সে উপায়ও ছিল না। পরে প্রথম আলোয় প্রকাশিত খবর দেখে এক বন্ধু ফোন করে জানাল, ব্রোঞ্জ পেয়েছি।

অলিম্পিয়াড মঞ্চ থেকে ব্রোঞ্জপদক নেওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে এবার বঞ্চিত হলাম। মন খারাপ হলেও বাস্তবতা তো মেনে নিতেই হবে। তবে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা সামলেও অলিম্পিয়াডে অংশ নিতে পেরেছি, আপাতত এটুকুই সান্ত্বনা।

আমাদের গল্প-আড্ডায়ও ঘুরেফিরে আসে গণিত

মনামী জামান
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

মনামী জামান, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ

গণিত অলিম্পিয়াডে প্রথমবারের মতো জাতীয় দলের সদস্য হিসেবে অংশ নেওয়ার সুযোগ আমার জন্য বড় পাওয়া। বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে প্যারেডে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা ছিল অন্য রকম। আমি বাংলাদেশ দলের একমাত্র নারী সদস্য। গানবাজনা, নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্র নিয়ে বর্ণাঢ্য প্যারেড ছিল উদ্বোধনীর সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। বাংলাদেশের পতাকা আর বেঙ্গল টাইগারের প্রতীক নিয়ে আমরা প্যারেডে অংশ নিই।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠান থেকেই সাইপ্রাস, জার্মানি, সুইজারল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে যায়। আমাদের গল্প-আড্ডায়ও ঘুরেফিরে আসে গণিত। এবার অলিম্পিয়াডের প্রশ্ন অন্য বছরের চেয়ে বেশ আলাদা ছিল বলা যায়। কঠিন বলব না, তবে বেশ সৃজনশীল ও ভিন্ন ধরনের প্রশ্ন দেখা গেছে। ৫ নম্বর প্রশ্নটি নিয়ে তো পরীক্ষার পরেও আমরা অনেক আলাপ করেছি। সঠিক সমাধান কী হতে পারে, তা নিয়েই গল্প করছিলাম। ৬টি সমস্যার মধ্যে ৩টির সঠিক সমাধান করে ২০ নম্বর পেয়ে আমি ব্রোঞ্জ জিতেছি। প্রথমবার অংশগ্রহণ করেই ব্রোঞ্জ, এতটা আশা করিনি। আমার লক্ষ্য ছিল সম্মানজনক স্বীকৃতি (অনারেবল মেনশন), সেখানে ব্রোঞ্জ জয় নিজের জন্যই বড় চমক। পরে ফলাফলের ওয়েবসাইট থেকে দেখেছি, এবারের আয়োজনে আমার অবস্থান ২১৬তম। এই ফলাফলে আমি খুশি।

১৮ জুলাই পরীক্ষা শেষে আমরা উইন্ডসর দুর্গ ও বাকিংহাম প্যালেস ঘুরতে গিয়েছিলাম। ১৯ জুলাই লন্ডন টাওয়ারসহ লন্ডনের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখেছি। মিলেনিয়াম ব্রিজ, বিগ বেন ঘড়ির মতো আলোচিত স্থাপনাগুলো মুগ্ধ হয়ে দেখার মতো। সঙ্গে নানা দেশের শিক্ষার্থীরা ছিল বলেই হয়তো ভ্রমণটা আরও উপভোগ করেছি। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ইউক্রেনের লোকজ সংস্কৃতির নানা দিক উঠে এসেছে। এভাবে অলিম্পিয়াডের মাধ্যমে শুধু সমস্যা সমাধান নয়, নতুন সংস্কৃতির সঙ্গেও পরিচিত হওয়ার সুযোগ মেলে।