হঠাৎ হাত-পা অবশ
অনেক সময় মানুষের শরীরের স্নায়ু আকস্মিকভাবে আক্রান্ত হয়ে হাত-পা অবশ হয়ে পড়ে। এ রোগকে গুলেইন-বারি সিনড্রোম (জিবিএস) বলে। ১৯১৬ সালে ফরাসি স্নায়ুবিদ জর্জ গুলেইন এবং জ্যাঁ আলেকজান্দ্রে বারি প্রথম এই রোগের কথা বর্ণনা করেন। এই রোগে যেকোনো বয়সের মানুষ যেকোনো সময় আক্রান্ত হতে পারেন। জেনে নেওয়া যাক রোগটির বিস্তারিত।
যে কারণে হয়
ধারণা করা হয়, কিছু ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস এই রোগের কার্যকারণের সঙ্গে সম্পর্কিত। যেমন ক্যাম্পেইলোবেকটার জেজুনি, এপসটেইন-বার ভাইরাস ইত্যাদি। এসব জীবাণু দিয়ে শরীরে সংক্রমণের তিন সপ্তাহের মধ্যে সাধারণত এই রোগ শুরু হয়। টিকা দেওয়ার পর গুলেইন-বারি সিনড্রোমে আক্রান্ত হয়েছেন, এমন রোগীও পাওয়া গেছে। গুলেইন-বারি সিনড্রোম একটি অটো ইমিউন রোগ বা আমাদের ইমিউন ব্যবস্থার ত্রুটির কারণে হয়ে থাকে। আমাদের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা স্বয়ংক্রিয়ভাবে শরীরে কোনো ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা অন্য জীবাণু প্রবেশ করার পর তার বিরুদ্ধে একধরনের প্রোটিন তৈরি করে, যা অ্যান্টিবডি নামে পরিচিত। অটো ইমিউন রোগের ক্ষেত্রে এই অ্যান্টিবডি সেই ক্ষতিকর জীবাণুর বিরুদ্ধে কাজ করার পাশাপাশি নিজের শরীরের কোষের বিরুদ্ধে কাজ করে তার ক্ষতি করতে থাকে। ধারণা করা হয়, কিছু জীবাণুর গঠনের সঙ্গে আমাদের শরীরের স্নায়ুর গঠনের কোথাও মিল আছে। সে কারণে অ্যান্টিবডি শরীরের স্নায়ুকে জীবাণু ভেবে ভুল করে আক্রমণ করে ফেলে। এর ফলে স্নায়ুতে প্রদাহ শুরু হয়, এই স্নায়ু শরীরের যে মাংসপেশিকে সরবরাহ করে, তা দুর্বল হয়ে পড়ে।
জানা থাক লক্ষণ
গুলেইন-বারি সিনড্রোমকে সংক্ষেপে জিবিএসও বলা হয়। এই রোগের অতিপরিচিত লক্ষণ হলো, হঠাৎ শুরু হওয়া পেশির দুর্বলতা; যা সাধারণত দুই পা থেকে শুরু হয় এবং পর্যায়ক্রমে হাতে ও অন্যান্য স্থানের স্নায়ুকেও আক্রান্ত করে। অনেক সময় ঘাড়, মুখ ও বুকের পাঁজরের স্নায়ু আক্রান্ত হয়। তখন রোগীর শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে কিংবা খাবার গিলতে কষ্ট হয়। কখনো হাত ও পায়ের আঙুল ঝিঁঝিঁ করা বা অবশ হয়ে যাওয়া লক্ষণ দেখা দিতে পারে। কিছু রোগী কোমরে ব্যথা এবং মাংসপেশিতে ব্যথার কথা বলেন। শরীরের কিছু স্নায়ু হৃৎস্পন্দন, শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করে, যা অটোনমিক স্নায়ু নামে পরিচিত। এগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলে রক্তচাপ ও হৃৎস্পন্দন ওঠানামা করার মতো সমস্যা হতে পারে। এই রোগের লক্ষণগুলো প্রথম দেখা যাওয়ার পর থেকে আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে এবং এক থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে সর্বোচ্চ লক্ষণ প্রকাশ পায়। লক্ষণের তীব্রতা রোগীভেদে আলাদা। অনেকের সমস্যা এত তীব্র হয় যে হাত-পা একটুও নাড়াতে পারেন না, পুরোপুরি শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। কারও তীব্র শ্বাসকষ্ট হয় ও খাবার গিলতে কষ্ট হয়। আবার অনেকের মৃদু লক্ষণ দেখা যায়। তীব্রতা বাড়তে বাড়তে সর্বোচ্চ লক্ষণ দেখা দেওয়ার কিছুদিন পর্যন্ত রোগের তীব্রতা স্থির থাকে। এরপর আবার ধীরে ধীরে স্নায়ুগুলো কর্মক্ষমতা ফিরে পেতে শুরু করে। পুরোপুরি স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা পেতে অনেকের কয়েক মাস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
বুঝবেন যেভাবে
লক্ষণ শুনে ও হাত-পায়ের স্নায়ু পরীক্ষা করে অনেকটাই ধারণা করা সম্ভব যে জিবিএস হয়েছে। রোগ নির্ণয় করার জন্য কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা হলো নার্ভ কন্ডাকশন স্টাডি। এ ছাড়া সিএসএফ স্টাডি বা স্পাইনাল ফ্লুইড পরীক্ষা, কিছু রক্ত পরীক্ষা, ইসিজিও করা হয়। রোগীর শ্বাসকষ্ট হলে আরও কিছু পরীক্ষা লাগতে পারে, যেমন স্পাইরোমেট্রি।
চিকিৎসা
লক্ষণ শুনে জিবিএস সন্দেহ হলে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া উচিত। চিকিৎসা নির্ভর করে রোগের লক্ষণ ও তীব্রতার ওপর। ফিজিওথেরাপি, নিবিড়ভাবে রক্তচাপ, হৃৎস্পন্দন, শ্বাসপ্রশ্বাস পর্যবেক্ষণ করা খুব জরুরি। অনেক সময় পাঁজরের পেশি অবশ হয়ে গেলে ও শ্বাসকষ্ট বেশি হলে ভেন্টিলেটর সাপোর্ট লাগতে পারে। গিলতে না পারলে খাবারের নল দিতে হতে পারে। কিছু গুলেইন-বারি সিনড্রোম রোগীদের ইমিউনোগ্লোবিউলিন, প্লাজমা এক্সচেঞ্জ দেওয়া হয়। রোগীর হাত-পায়ের শিরাতে রক্ত জমাট বাঁধার আশঙ্কা থাকে। তাই বিশেষ ধরনের মোজা ব্যবহার, রক্ত তরল রাখার ওষুধ লাগতে পারে। ফিজিওথেরাপি ও অকুপেশনাল থেরাপি এসব রোগীর জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।
আক্রান্ত রোগীর ভবিষ্যৎ
প্রতি ১০ জনের ৭-৮ জন রোগী ৬ থেকে ১২ মাসের মধ্যে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যান। প্রতি ১০ জনের ১-২ জন রোগী কিছু স্থায়ী দুর্বলতায় ভোগেন। প্রতি ২০ জনে ১ জন রোগীর মারা যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। তবে আশার কথা হচ্ছে, তীব্র লক্ষণ নিয়ে আসা গুলেইন-বারি সিনড্রোমের অনেক রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন। সঠিক সময় রোগ ধরা পড়া ও সঠিক সাপোর্ট খুব জরুরি।