ধারণা করা হয়, বিশ্বব্যাপী ১০০ কোটি মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। দিন দিন এই সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাবে। এর কারণ হিসেবে মানুষের অসচেতনতা ও অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপনকে দায়ী করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
মানুষকে উচ্চ রক্তচাপ বিষয়ে সচেতন করতে ১৭ অক্টোবর পালিত হয়েছে বিশ্ব উচ্চ রক্তচাপ দিবস। এ উপলক্ষে আয়োজন করা হয় এসকেএফ নিবেদিত স্বাস্থ্যবিষয়ক বিশেষ অনুষ্ঠান ‘হৃদয়ের সুরক্ষা’। তৃতীয় ও শেষ পর্বের প্রতিপাদ্য ছিল ‘আপনার রক্তচাপ জানুন, নিয়ন্ত্রণ করুন, দীর্ঘদিন বাঁচুন’। চিকিৎসক তানিয়া আলমের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের বিভাগীয় প্রধান এবং সহযোগী অধ্যাপক ডা. খন্দকার মো. নূরুস সাবা। অনুষ্ঠানটি ১৮ অক্টোবর প্রথম আলোর ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেল থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। এ ছাড়া সম্প্রচারিত হয় এসকেএফের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজ থেকে।
অনুষ্ঠান শুরু হয় উচ্চ রক্তচাপ আসলে কী এবং কখন তা বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়—এ বিষয়ে আলোকপাতের মধ্য দিয়ে। ডা. খন্দকার মো. নূরুস সাবা বলেন, বর্তমানে আমাদের দেশে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে শতকরা ২০ জনের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে। আশঙ্কার কথা এই যে এখন শিশু–কিশোরদের মধ্যেও শতকরা ১০ জন উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে। রক্তচাপ কখন বেশি বা কম, তার একটি সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন রয়েছে।
রক্তচাপের দুটি সংখ্যার মধ্যে যেটি বেশি, সেটি হলো সিস্টোলিক, আর কম সংখ্যাটি নির্দেশ করে ডায়াস্টোলিক ব্লাড প্রেশার। প্রতিটি হৃৎস্পন্দনের সময় হৃৎপিণ্ড সংকুচিত হয় এবং সেই চাপে রক্ত সমগ্র শরীরের ধমনিতে ছড়িয়ে পড়ে। রক্তনালির দেয়ালে এ সময় রক্ত যে চাপ দেয়, এটিই হচ্ছে সিস্টোলিক প্রেশার। আর দুটি হৃৎস্পন্দনের মধ্যবর্তী সময়ে অর্থাৎ হৃৎপিণ্ড যখন শিথিল থাকে, সে সময়ে ধমনির গায়ে রক্তের যে চাপ বিরাজমান থাকে, সেটাই ডায়াস্টোলিক প্রেশার।
আমাদের হৃৎপিণ্ড ঠিকভাবে কাজ করছে কি না, তা বোঝার জন্য রক্তচাপের একটি উপযুক্ত নির্দেশিকা রয়েছে, যেখানে মূলত চারটি ভাগ রয়েছে। ১. স্বাভাবিক রক্তচাপে সিস্টোলিক প্রেশার ১২০-এর কম এবং ডায়াস্টোলিক প্রেশার ৮০-এর কম। ২. উচ্চ রক্তচাপের পূর্বাবস্থা বা প্রি-হাইপারটেনশনে সিস্টোলিক প্রেশার ১২০ থেকে ১৩৯ এবং ডায়াস্টোলিক প্রেশার ৮০ থেকে ৮৯। ৩. উচ্চ রক্তচাপ স্টেজ–১-এর ক্ষেত্রে সিস্টোলিক প্রেশার ১৪০ থেকে ১৫৯ এবং ডায়াস্টোলিক প্রেশার ৯০ থেকে ৯৯। ৪. উচ্চ রক্তচাপ স্টেজ–২-এর ক্ষেত্রে সিস্টোলিক প্রেশার ১৬০ বা এর বেশি এবং ডায়াস্টোলিক প্রেশার ৯০-এর বেশি। কারও প্রেশার যদি এর থেকেও বেশি থাকে, তবে তা মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
উচ্চ রক্তচাপ সম্পর্কে জানতে সঠিকভাবে তা নির্ণয় করা জরুরি। এ বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করে ডা. খন্দকার মো. নূরুস সাবা জানান, নির্ভুলভাবে প্রেশার মাপা জরুরি। তবে রক্তচাপ মাপার আগে নিজেকে কিছুটা প্রস্তুত করে নিতে হবে। প্রেশার মাপার আধঘণ্টা বা এক ঘণ্টা আগে চা, কফি, পান বা ভরপেট খাওয়া উচিত নয়। ধূমপান, শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম করলেও একই নিয়ম প্রযোজ্য। তাই উত্তেজনা এড়িয়ে প্রেশার মাপার পাঁচ মিনিট আগে একটু শান্ত হয়ে বসুন। বাহুবন্ধনী যাতে বাহুতে সঠিকভাবে লাগানো যায়, সেদিকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। বাহুতে খুব শক্তভাবে কাফ বাঁধবেন না। তাহলে রক্তচাপের ‘রিডিং’ যথার্থ হবে না। মাপার সময় কথা না বলাই ভালো। পা গুটিয়ে বা আড়াআড়ি করে বসবেন না। পা মাটিতে ছুঁইয়ে রাখুন।
যাঁরা উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন, তাঁদের জন্য রয়েছে কিছু বাড়তি সতর্কতা, যা মেনে চললে যেকোনো ধরনের ঝুঁকি থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চলা সম্ভব হবে। এ বিষয়ে থেকে ডা. খন্দকার মো. নূরুস সাবার পরামর্শ হচ্ছে স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, ক্যালরি হিসাব করে খাওয়া এবং কতটুকু খাচ্ছেন, তা হিসাব করা খুবই প্রয়োজন। এতে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি ওষুধের পরিমাণও কমিয়ে আনা সম্ভব।
প্রথমেই লবণ খাওয়া কমাতে হবে। বেশি লবণ বা সোডিয়ামযুক্ত খাবার রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়। দৈনিক ২৩০০ মিলিগ্রাম বা ১ চা–চামচের কম লবণ খাওয়া উচিত। প্রক্রিয়াজাত খাবার, রেডি টু ইট বা তৈরি খাবার ও ফাস্টফুড এড়িয়ে চলুন। পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম ও আঁশসমৃদ্ধ খাবার রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। ফল ও সবজিতে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম ও আঁশ আছে। এগুলোয় সোডিয়ামের পরিমাণও কম। আস্ত ফল ও সবজি খাওয়া জুস খাওয়ার চেয়ে ভালো। কারণ, জুসে খাবারের আঁশ বাদ পড়ে যায়। এ ছাড়া বাদাম, শস্যদানা, ডাল, চর্বি ছাড়া মাংস ম্যাগনেশিয়ামের ভালো উৎস।