আমাদের পাঁচ ইন্দ্রিয়ের একটি হচ্ছে শ্রবণেন্দ্রিয়। কান দিয়ে আমরা শুনি অথচ গুরুত্ব দিই কম। আর এই কানে শোনার যত্নে বরাবরই আমরা উদাসীন। এর ফলে বধিরতা পর্যন্ত হতে পারে। কানের যত্ন সবারই নেওয়া উচিত। তবে শিশু, বৃদ্ধ ও অন্তঃসত্ত্বা নারীদের বিশেষ সতর্কতা নেওয়া দরকার। বিশ্বে ৫ শতাংশের বেশি মানুষের কোনো না কোনো মাত্রায় শ্রবণহীনতা রয়েছে।
সমীক্ষায় দেখা যায়, আমাদের দেশের প্রায় ৯ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ যেকোনো মাত্রার বধিরতায় ভুগে থাকেন। একটু সচেতন হলে এড়ানো যায় কানের অনেক রোগ।
সচেতনতা হচ্ছে যেকোনো রোগ প্রতিরোধের প্রাথমিক পদক্ষেপ। শ্রবণশক্তি কমে যাওয়া রোধ এবং বিশ্বজুড়ে শ্রবণশক্তির যত্ন কীভাবে নেওয়া যায়, সে সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে প্রতিবছরের ৩ মার্চ বিশ্ব শ্রবণ দিবস পালন করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) উদ্যোগে ২০০৭ সালের এই দিনে প্রথমবারের মতো পালিত হয় বিশ্ব শ্রবণ দিবস। প্রতিবছরই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটি নতুন স্লোগান ঘোষণা করে। এবারের ২০২২ সালের স্লোগান বা থিম হচ্ছে: ‘শুনতে চাইলে আজীবন; কানে শোনায় চাই সযতন’।
এই প্রতিপাদ্যের তাৎপর্য হচ্ছে আমরা মনে করি এখন ভালো শুনতে পাচ্ছি বলে কোনো সমস্যাই হচ্ছে না বা হবে না। কিন্তু শব্দদূষণজনিত বেশ কিছু কাজ আমরা প্রতিনিয়ত করে যাচ্ছি সেগুলোর কিছু দীর্ঘমেয়াদি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। ফলে আমাদের অন্তঃকর্ণের বিশেষ একধরনের কোষ ধ্বংস হয়ে স্থায়ীভাবে শ্রবণের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ট্রাফিক পুলিশ, নির্মাণশ্রমিক, উচ্চশব্দের যন্ত্র চালনাকারী, ইঞ্জিনচালিত নৌকার মাঝি, ব্যান্ডদলের বাদক-গায়ক, পরিবহনশ্রমিক, ব্যস্ততম সড়কের পাশে যাঁদের বাড়ি রয়েছে, তাঁরা সাধারণত লাগাতার শব্দদূষণে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। মানুষের কানের সহনীয় শব্দমাত্রা সাধারণত ৫৫ থেকে ৬০ ডেসিবেল। কিন্তু টানা এই মাত্রা ৮৫ ডেসিবেলের বেশি হলে শ্রবণশক্তির ক্ষতি হতে পারে।
শ্রবণশক্তি কমে যাওয়া ঠেকাতে
* অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় মায়ের যত্ন নেওয়া এবং সময়মতো রুবেলা, বসন্ত, হাম ইত্যাদির টিকা দেওয়া। এ সময় অটোটক্সিক বা শ্রবণের জন্য ক্ষতিকারক ওষুধ গ্রহণে বিরত থাকা। সব টিকাদান কর্মসূচি জোরদার করা।
* শিশুর বেড়ে ওঠার অন্যতম প্রধান উপাদান শুনতে পাওয়া। ‘শোনা’—শিশুর কথা বলা, সামাজিক যোগাযোগ এবং শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। শিশুর দাঁত ওঠা, হাঁটাচলার পাশাপাশি শব্দের প্রতি সাড়া দিচ্ছে কি না, সেদিকে নজর রাখা উচিত। সাধারণত জন্মের পর তিন মাস বয়সে আপনার শিশু ঘাড় ঘোরাতে পারবে এবং আপনার কথার উত্তরে হাসতে পারবে। ৬-১২ মাসের মধ্যে আপনার শিশু ভাঙা ভাঙাভাবে তার কথা বলতে শুরু করবে। ১৫ থেকে ১৮ মাস বয়সের মধ্যে শিশু সহজ কয়েকটি কথা বলতে পারবে। এগুলো যদি না হয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে মা-বাবা একটু চিন্তিত হয়ে পড়তেই পারেন। এ ছাড়া কানে কম শুনলে শিশুও হতাশ, মনমরা হয়ে থাকবে। যদি স্বাভাবিক নিয়মে এগুলো শিশুর বেড়ে ওঠার মধ্যে দেখা না যায়, তখন অবশ্যই দ্রুত নাক কান গলা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেবেন।
* গবেষণায় দেখা গেছে, দীর্ঘ সময় উচ্চ শব্দে বা ভলিউমে গান শোনা শ্রবণশক্তি কমিয়ে দেয়; তরুণ প্রজন্মের জন্য যা অশনিসংকেত। তাই অবশ্যই হেডফোনে গান শোনার সময় বিরতি দিয়ে এবং ভলিউম কমিয়ে অর্থাৎ যন্ত্রের ৬০ শতাংশ পর্যন্ত রেখে গান শোনা উচিত।
* একনাগাড়ে জোরালো শব্দের কারণে অন্তঃকর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে শ্রবণশক্তি কমে যেতে পেতে পারে। তাই কলকারখানার শ্রমিকদের ক্ষেত্রে কাজের সময় ইয়ারপ্লাগ ব্যবহার এবং নিয়মিত স্ক্রিনিংসহ বিশেষ নজর দেওয়া সময়ের দাবি। গাড়িচালকদের অযথা হর্ন বাজানো থেকে বিরত থাকা উচিত। অপ্রয়োজনীয় শব্দ দূষণরোধে প্রয়োজনে আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করা উচিত।
* হিয়ারিং এইড সহজলভ্য করা এবং এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করা প্রয়োজন। পাশাপাশি সব সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কানের শ্রবণশক্তি পরীক্ষা বা অডিওলজি টেস্টের ব্যবস্থা সহজলভ্য করার মাধ্যমে শ্রবণশক্তি রোধ সম্ভব। কারও এরই মধ্যে শুনতে পাওয়ার কতটুকু ক্ষতি হয়েছে, তা জানতে অডিওগ্রাম নামে পরিচিত হেয়ারিং টেস্ট সম্পর্কে জনমনে ধারণা দিতে হবে। কারণ, যাঁরা শ্রবণশক্তি হারিয়েছেন তাঁরা প্রাথমিক শনাক্তকরণ এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে উপকৃত হতে পারেন।
* যদি হঠাৎ করেই কেউ কানে কম শোনার সমস্যায় আক্রান্ত হন তাহলে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা করা উচিত। যত দ্রুত সাডেন হিয়ারিং লসের রোগী তার চিকিৎসকের কাছে যাবেন তত দ্রুত আরোগ্য লাভ করার সম্ভাবনা।
চোখে কম দেখা যেমন স্বাভাবিক, তেমনই কানে কম শোনাও অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু কানে কম শোনার সমস্যা নিয়ে আমাদের সমাজে প্রায়ই হীনম্মন্যতায় ভুগতে দেখা যায়। তাই মনে রাখতে হবে কানে কম শোনা বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে একটি প্রচলিত সমস্যা। আর এ জন্য কানে কম শোনার সঠিক কারণ নির্ণয় এবং সমস্যা প্রতিরোধের জন্য সচেতনতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।
ডা. মো. আব্দুল হাফিজ, নাক কান গলা রোগ বিশেষজ্ঞ এবং হেড-নেক সার্জন, সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।