মাথাব্যথা ও মাইগ্রেন চিকিৎসায় করণীয়
মাথাব্যথার অনেক ধরন রয়েছে। মাইগ্রেন তার মধ্যে একটি। বিশ্বে প্রায় ১৫ শতাংশ মানুষ মাইগ্রেনজনিত মাথাব্যথার সমস্যায় ভোগেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কমস্থলে অনুপস্থিতি অথবা কর্মক্ষমতা হ্রাসের অন্যতম কারণ এই মাইগ্রেন। মাইগ্রেনের ব্যথার নানা দিক সম্পর্কে জানা গেল মাইগ্রেন ও মাথাব্যথা সচেতনতা সপ্তাহ উপলক্ষে আয়োজিত এসকেএফ নিবেদিত বিশেষ অনুষ্ঠান ‘মাথা নিয়ে মাথাব্যথা’র দ্বিতীয় পর্বে।
এ পর্বের বিষয় ছিল ‘মাথাব্যথা ও মাইগ্রেন চিকিৎসায় করণীয়’। ডা. শ্রাবণ্য তৌহিদার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে ছিলেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হসপিটালের নিউরোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী। অনুষ্ঠানটি ৭ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোর ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেল এবং এসকেএফের ফেসবুক পেজ থেকে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়।
প্রথমেই জানা গেল মাথাব্যথা ধরন সম্পর্কে। মাথাব্যথা দুই রকমের। প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি মাথাব্যথা। প্রাইমারি মাথাব্যথার সে রকম কোনো নির্দিষ্ট কারণ পাওয়া যায় না। টেনশন থেকে মাথাব্যথা ও মাইগ্রেন প্রাইমারি মাথাব্যথার অন্তর্ভুক্ত। মাইগ্রেনের রোগীরা বিভিন্ন ধরনের উদ্দীপনার প্রতি সংবেদনশীল হয়ে থাকে। কারও দেখা যায় রোদে গেলে বা মানসিক চাপে থাকলে মাথাব্যথা বেড়ে যায়। প্রাইমারি মাথাব্যথা একটি নিউরোভাস্কুলার সমস্যা। অর্থাৎ মস্তিষ্কের স্নায়ু ও রক্তনালির সংবেদনশীলতার জন্য মাইগ্রেনের ব্যথা শুরু হয়। এ ব্যথা শুরু হয় মাথার একপাশ থেকে। এ অবস্থাকে হেমিক্রেনিয়া বলে। মাথার একাংশ দপদপ করে ব্যথা করে। ব্যথা কখনো হঠাৎ থেমে গিয়ে কয়েক দিনের বিরতি নিয়ে আবার শুরু হতে পারে। মাইগ্রেনের ব্যথা চার ঘণ্টা থেকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
প্রাইমারি মাথাব্যথার সে রকম কোনো নির্দিষ্ট কারণ পাওয়া যায় না। টেনশন থেকে মাথাব্যথা ও মাইগ্রেন প্রাইমারি মাথাব্যথার অন্তর্ভুক্ত। মাইগ্রেনের রোগীরা বিভিন্ন ধরনের উদ্দীপনার প্রতি সংবেদনশীল হয়ে থাকে।
ব্যথার সঙ্গে সঙ্গে আলো বা শব্দের প্রতি সংবেদনশীলতা হয় অথবা বমি বা বমি বমি ভাব থাকতে পারে। কারও যদি এই সমস্যা পরপর পাঁচবার বা তার চেয়ে বেশিবার হয়ে থাকে, তাহলে ধরে নিতে হবে তিনি মাইগ্রেনের ব্যথায় আক্রান্ত।
মাইগ্রেনের চিকিৎসার সময় অবশ্যই রোগীর তথ্য এবং রোগের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে হবে। কোন বয়স থেকে ব্যথা শুরু হয়েছে, সঙ্গে অন্য কোনো উপসর্গ আছে কি না, কী কী কাজ করলে ব্যথাটা বাড়ে, কী কী কাজ করলে ব্যথাটা কমে, পরিবারের অন্য কোনো সদস্য এই ব্যথায় ভুগছে কি না, কোন ওষুধ খেলে ব্যথাটা কমে—এসব সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা নিতে হয়। মাইগ্রেনের চিকিৎসা দুই ধরনের। একটি হলো তাৎক্ষণিক চিকিৎসা আর অন্যটি প্রতিরোধক চিকিৎসা। তাৎক্ষণিক চিকিৎসায় সঙ্গে সঙ্গে ব্যথা কমানোর জন্য ওষুধ দেওয়া হয়। আর প্রতিরোধক চিকিৎসায় ব্যথা যাতে না ওঠে, তার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে মাইগ্রেনের ট্রিগার ,অর্থাৎ যেসব কারণে ব্যথা শুরু হয়, সেগুলো খুঁজে বের করে যদি এড়িয়ে চলতে পারা যায়, তাহলে মাইগ্রেনের ব্যথা থেকে পুরোপুরি রেহাই পাওয়া সম্ভব। এ জন্য অনেক সময় জীবনযাত্রারও পরিবর্তন করতে হতে পারে।
তাৎক্ষণিক ব্যথা কমানোর জন্য ব্যথানাশক, যেমন: প্যারাসিটামল বা এনেসিস, নেপ্রসিন–জাতীয় ওষুধের সঙ্গে অ্যান্টি–ইমেটিক সাত দিন বা এর কমবেশি সময়ে খাওয়া লাগতে পারে। প্রতিরোধক চিকিৎসার কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। কারও তিন থেকে ছয় মাস বা কারও এক বছরের মতো চিকিৎসা চলতে থাকে। এ সময় কিছু ওষুধ সেবন করতে হয়। রোগীর বয়স, লিঙ্গ, পেশা, অন্য কোনো রোগ, যেমন: প্রেশার, ডায়বেটিস, হার্টের কোনো সমস্যা আছে কি না, কোনো ওষুধে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কি না—এসব জেনে নিয়ে চিকিৎসকেরা রোগীর জন্য উপযুক্ত ওষুধ ঠিক করেন। এই ওষুধের মাত্রা অল্প পরিমাণে শুরু করে আস্তে আস্তে বাড়ানো হয়। এ থেকে চিকিৎসকেরা বুঝতে পারেন ওষুধের কোন মাত্রায় রোগীর ব্যথাটা কমে যায়। মাইগ্রেন চিকিৎসার জন্য নতুন কিছু পদ্ধতি এসেছে। এর ভেতর এফডিএ অনুমোদিত পদ্ধতিগুলো মধ্যে আছে ট্রান্সকিউটেনাস নার্ভ স্টিমুলেশন, বোটক্স ইনজেকশন, রিলাক্সেশন থেরাপির মতো কিছু চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসায় মাইগ্রেনের ব্যথা না সারলে এ ধরনের চিকিৎসা নেওয়া যেতে পারে।
করোনার সময় কারও মাইগ্রেনের সমস্যা হয়ে থাকলে টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা নেওয়া যেতে পারে। আর এই সময়ে সবার উচিত দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ, অবসাদগ্রস্ততা থেকে বেরিয়ে উৎফুল্ল থাকার চেষ্টা করা। কারণ, এসবের জন্যও মাইগ্রেনের ব্যথা বাড়তে পারে। আবার করোনার অন্যতম একটি উপসর্গ হলো মাথাব্যথা। করোনার মাথাব্যথার সঙ্গে মাইগ্রেনের ব্যথার কোনো সম্পর্ক নেই।
মাইগ্রেনের ব্যথা ছাড়াও আরও কিছু মাথাব্যথা আছে, যার জন্য অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। কখনো কখনো দেখা যায় কারও হঠাৎ করে তীব্র মাথাব্যথা এবং তার সঙ্গে বমি শুরু হয়ে থাকে। আবার কারও মস্তিষ্কে ইন্টারসেরিব্রাল হেমারেজ হয়ে থাকলে মাথাব্যথা হয়। আবার মাথাব্যথার সঙ্গে শরীরের ভঙ্গি বা পশ্চারের পরিবর্তন হয় বা নাড়াচাড়া করলে ব্যথা বাড়ে বা কখনো দেখা যায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে চিকিৎসকেরা জরুরি ভিত্তিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে থাকেন। রুটিন ইনভেস্টিগেশনের পাশাপাশি সিটিস্ক্যান বা এমআরআই করতে হবে। এতে যদি কোনো রোগ, যেমন মস্তিষ্কে টিউমার বা রক্তনালির কোনো সমস্যা ধরা পড়ে, তাহলে সেই রোগেরও তাৎক্ষণিক চিকিৎসা করতে হবে।
অনুষ্ঠানের শেষ দিকে ডা. মো. তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী দর্শকদের মাইগ্রেন ও মাথাব্যথা–সম্পর্কিত প্রশ্নের জবাব দেন।