মাথাব্যথা সবারই হয়। তবে এর প্রবণতা মহিলা ও বয়স্কদের মধ্যে একটু বেশি। তাঁদের মাথাব্যথা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো ‘মাইগ্রেন ও মাথাব্যথা সচেতনতা সপ্তাহ’ উপলক্ষে আয়োজিত এসকেএফ নিবেদিত ‘মাথা নিয়ে মাথাব্যথা’ অনুষ্ঠানের চতুর্থ পর্বে। এ পর্বের বিষয় ছিল ‘মহিলা ও বয়স্কদের মাথাব্যথা’। ডা. লুবাইনা হকের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে ছিলেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স অ্যান্ড হসপিটালের নিউরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. এম আমির হোসেন। অনুষ্ঠানটি ৯ সেপ্টেম্বর একযোগে সরাসরি সম্প্রচারিত হয় প্রথম আলোর ফেসবুক পেজ এবং ইউটিউব চ্যানেল ও এসকেএফের ফেসবুক পেজ থেকে।
আলোচনার শুরুতেই মাথা ও মাথাব্যথা নিয়ে একটি প্রাথমিক ধারণা দেওয়া হয়। চোখের ভ্রু থেকে শুরু করে পেছনে চুলের গোড়ার শেষ পর্যন্ত পুরোটাই মাথার অংশ। মাথার ভেতরে যে মস্তিষ্কের রক্তনালি, পর্দা বা মেনিনজেস, হাড়, সাইনাস, মাংসপেশি, চামড়া—এগুলো থেকেই মাথাব্যথার উৎপত্তি। অর্থাৎ এসবের কোনো একটির সমস্যাই মাথাব্যথার কারণ হয়ে থাকে। মাথাব্যথা দুই রকমের। প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি। প্রাইমারি মাথাব্যথার নির্দিষ্ট কোনো কারণ থাকে না। টেনশন ও মাইগ্রেন এই শ্রেণির মাথাব্যথার অন্তর্ভুক্ত। সেকেন্ডারি মাথাব্যথা অনেক কারণেই হতে পারে। যেমন জ্বর, কোনো ইনফেকশন, আঘাতজনিত কারণ, মস্তিষ্কে টিউমার বা স্ট্রোক প্রভৃতি। এ ছাড়া শরীরে অন্য কোনো রোগ বা প্রদাহ থেকেও মাথাব্যথা হতে পারে।
মহিলারা সাধারণত দুশ্চিন্তাজনিত মাথাব্যথা ও মাইগ্রেনে বেশি আক্রান্ত হন। মাইগ্রেনে পুরুষদের চেয়ে মহিলারা বেশি ভোগেন। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতি ১৫ জন পুরুষের মধ্যে একজন এবং প্রতি ৫ জন মহিলার মধ্যে একজন মাইগ্রেনে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। এ ছাড়া গর্ভকালে নানা জটিলতার জন্য মাথাব্যথা হতে পারে। যেমন গর্ভকালে রক্তচাপ বেড়ে যায়, যাকে প্রিকামসিয়া বলা হয়। আবার এ সময় রক্তনালি বা শিরা ব্লক হয়ে যেতে পারে। এসব কারণে মাথাব্যথা হতে পারে।
এ ছাড়া গর্ভবতী মহিলাদের শরীরে হরমোনের অনেক পরিবর্তন হয়। হঠাৎ এই পরিবর্তনের ফলে মস্তিষ্কে যদি আগে থেকে কোনো সমস্যা থাকে, তাহলে তা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। যেমন টিউমার বড় হতে পারে, আরটিওভেনাস ম্যালফরমেশন বা রক্তনালির জটলার জন্য যে রক্তপ্রবাহ হয়, তার মাত্রাও বৃদ্ধি পেতে পারে। মোট কথা, মহিলাদের প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি মাথাব্যথা অন্য সবার মতোই হয়ে থাকে আর বাড়তি ব্যথাটা হয় গর্ভকালে। এ ধরনের সমস্যায় চিকিৎসক ব্যথানাশক ও প্রতিরোধক—এ দুধরনের চিকিৎসা করে থাকেন। দুটি ক্ষেত্রেই রোগীকে এমন ওষুধ দেওয়া হয় যাতে বাচ্চার কোনো ক্ষতি না হয়।
ব্যথার চিকিৎসায় প্যারাসিটামল শ্রেণির ব্যথানাশকের সঙ্গে বমির ওষুধ দেওয়া হয়। আর প্রতিরোধক চিকিৎসায় প্রপাননল, ক্যালসিয়াম চেইন ব্লকার, ইমিট্রিপটাইলন-জাতীয় ওষুধগুলো স্বল্পমাত্রায় দেওয়া হয়। তবে গর্ভবতী মহিলারা দুশ্চিন্তামুক্ত থাকার পাশাপাশি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখলে তাঁদের মাথাব্যথা হবে না। আবার গর্ভ-পরবর্তী অবস্থায় বিশেষ সিজারিয়ান সেকশন ডেলিভারির পর মস্তিষ্কের সেরেব্রস্পাইনাল ফ্লুইড বা সিএসএফ কমে গেলে মাথায় কম চাপ পড়ে। এ জন্যও মাথাব্যথা হতে পারে। এ সময় চিকিৎসকেরা রোগীকে বালিশ ছাড়া শুয়ে থাকার এবং বেশি বেশি পানি পানের পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
অল্প বয়সে বেশির ভাগ মাথাব্যথা হয় প্রাইমারি লেভেলের। তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সেকেন্ডারি মাথাব্যথা বাড়তে থাকে। বয়স্ক মানুষের কপালের দুপাশে ব্যথা হলে সেটা টেম্পোরাল আরটেরাইটিস হতে পারে, যা আসলে মস্তিষ্কের রক্তনালির প্রদাহ। অনেক সময় মুখের একপাশে বিদ্যুতের ঝলকের মতো ব্যথা হয়ে থাকতে পারে। একে ট্রাইজেনিয়াল নিউরালজিয়া বলে। আবার ঘাড়ের ক্ষয়ের জন্য মাথাব্যথা হতে পারে। এ ছাড়া উচ্চরক্তচাপ, স্ট্রোক, টিউমার, কোনো ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় বয়স্ক মানুষের মাথাব্যথা খুবই সাধারণ কারণ। বয়স্ক মানুষের প্রাইমারি মাথাব্যথা যে হয় না, তা নয়। তবে তার ধরনটি অল্পবয়সীদের থেকে আলাদা হয়। যেমন মাইগ্রেনের ব্যথার ক্ষেত্রে অল্প বয়সে মাথাব্যথাটাই মুখ্য থাকে। কিন্তু বয়স বাড়লে মাথাব্যথার পাশাপাশি চোখে ঝাপসা দেখা, মাথা ঘোরানো, শরীরের কোনো অংশ ঝিম ধরে থাকার মতো ব্যতিক্রমী উপসর্গগুলো বেশি দেখা যায়।
অনুষ্ঠানে ব্রেন টিউমার নিয়েও আলোচনা করা হয়। কারণ বয়স্ক মানুষের ব্রেন টিউমার হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। প্রচণ্ড মাথাব্যথা, ব্যথার সঙ্গে বমিভাব বা বমি হওয়া, হাঁটাচলা বা কাজ করলে যদি ব্যথা বাড়ে, পজিশন পরিবর্তন করলে যদি ব্যথার তারতম্য হয়, সকালের দিকে যদি ব্যথা বেশি হয়, পাশাপাশি খিঁচুনি অথবা শরীরের একপাশ অবশ লাগে, তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে গিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে।
বয়স্ক মানুষের স্ট্রোকের প্রবণতাও অনেক বেশি। মস্তিষ্কের রক্তনালি ব্লক বা ছিঁড়ে গেলে স্ট্রোক হয়। এ জন্য মাথায় অস্বাভাবিক রকমের তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়। এ ধরনের মাথাব্যথা হলে সিটি স্ক্যান করে নিশ্চিত হতে হবে রোগীর স্ট্রোক করেছে কি না। বয়স্ক রোগীদের ক্ষেত্রে মাথাব্যথা হলেই সিটি স্ক্যান করাতেই হবে। আর গালের চোয়াল বা ঘাড়ের হাড়ের ক্ষয়জনিত কারণে ব্যথা হলে এক্স-রে করতে হবে। মোট কথা, বয়স্ক মানুষের যেকোনো ধরনের মাথাব্যথাকে সব সময় গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। এবং মাথাব্যথা জাতীয় কোনো রকমের সমস্যা দেখা দিলেই দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
অনুষ্ঠানের শেষ দিকে ডা. এম আমির হোসেন দর্শকদের মাথাব্যথা- সম্পর্কিত অনেক প্রশ্নের জবাব দেন।