পা ফোলায় দুশ্চিন্তা

পা ফুলে গেলে দুশ্চিন্তায় ভ্রু কুঁচকানোরই কথা। কারও দুই পা ফুলতে পারে, আবার কারও এক পা। কারও সব সময়ই পা ফুলে থাকে, কারও সাময়িক—যেমন দীর্ঘক্ষণ বসে থাকলে বা ভ্রমণ করলে।

যাঁদের উচ্চতা অনুযায়ী শরীরের ওজন অনেক বেশি, তাঁদের পা একটু ফোলা থাকতে পারে। যাঁরা একনাগাড়ে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে কাজ করেন, তাঁদেরও এমন সমস্যা হতে পারে। দীর্ঘ সময় পা ঝুলিয়ে বসে থাকলে বা দীর্ঘ সময়ের বসা ভ্রমণের (৪ ঘণ্টার বেশি) ক্ষেত্রেও এমনটা হতে পারে। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থার শেষ চার মাস সময়ে অনেকের পা ফুলতে পারে, এটা স্বাভাবিক। ব্যথানাশক ওষুধ, উচ্চ রক্তচাপে ব্যবহৃত কিছু ওষুধ এবং জন্মনিয়ন্ত্রণের ওষুধ সেবনের প্রভাবেও পা ফুলতে পারে। তবে এসব নিরীহ কারণ ছাড়াও পা ফোলাটা হতে পারে গুরুতর কিছু রোগের পূর্বাভাস বা উপসর্গ। তাই বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া ভালো।

প্রথম দিকে অনেকে পা ফোলার বিষয়টা খেয়াল না–ও করতে পারেন। আবার খেয়াল করলেও অনেকে আমলে নেন না। কিন্তু যেকোনো পা ফোলাকেই গুরুত্ব দেওয়া উচিত। চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত। কারণ, পা ফোলা অনেক অসুখের প্রাথমিক উপসর্গ। সময়মতো একে গুরুত্ব না দিলে সঠিক কারণ নির্ণয় ও চিকিৎসা বিলম্ব হতে পারে।

পা ফোলা আর কিছুই নয়, শরীরে পানি জমার একটি লক্ষণ। শরীরের সর্বনিম্ন অংশ হওয়ার কারণে পায়ের পাতা ও গোড়ালিতে এর উপস্থিতি আগে বোঝা যায়। গোড়ালির একটু ওপরে ভেতরের দিকে হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে কমপক্ষে ১৫ সেকেন্ড চেপে ধরে রাখলে আঙুল দেবে যাওয়ার চিহ্ন দেখা যেতে পারে। কেউ ঘরে বসেই পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। তবে স্বল্প পরিমাণ পানি জমলে তা নির্দিষ্টভাবে এভাবে না–ও বোঝা যেতে পারে।

আমাদের শরীরের পানির ভারসাম্য বজায় রাখতে হৃদ্‌যন্ত্র, রক্তনালি, কিডনি ও লিভার সমন্বিতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই শরীরে পানি জমার কোনো লক্ষণ পাওয়া গেলে এসব অঙ্গ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখার দরকার পড়ে। শরীরে পানি জমার পরিমাণ বাড়তে থাকলে পা ছাড়াও পেট বা মুখ দেখলে ফোলা মনে হতে পারে। পেটে পানি জমার উপস্থিতি চিকিৎসক পরীক্ষা করে দেখলে বুঝতে পারেন।

পা ফোলার যত কারণ

হৃদ্‌রোগ: হৃদ্‌যন্ত্র আমাদের পুরো শরীরে রক্ত সঞ্চালন করে। হৃদ্‌যন্ত্রের রক্ত সঞ্চালন করার এই কর্মক্ষমতা কমে গেলে তাকে ‘হার্ট ফেলিউর’ বলা হয়। জন্মগত হৃদ্‌রোগ, বিশেষ করে হৃদ্‌যন্ত্রের জন্মগত ত্রুটিপূর্ণ ভালভের অসুখ, হার্ট অ্যাটাকের পর হৃদ্‌যন্ত্রের ক্ষমতা কমে গেলে হার্ট ফেলিউর হয় আর পা ফুলতে পারে। ফুসফুসের বিভিন্ন অসুখ থেকেও হার্ট ফেলিউর হতে পারে। পা ফোলা ছাড়াও শ্বাসকষ্ট হার্ট ফেলিউরের প্রধান লক্ষণ। শুরুতে দ্রুত হাঁটা বা দৌড়ানোর মতো পরিশ্রমে শ্বাসকষ্ট হয়। ধীরে ধীরে কম পরিশ্রমেও শ্বাসকষ্ট হতে পারে। তখন সামান্য হাঁটাহাঁটি বা নিজের দৈনন্দিন কাজগুলোতেও শ্বাসকষ্ট হয়। শ্বাসকষ্টের জন্য এরা চিত হয়ে শুয়ে ঘুমাতে পারেন না বা ঘুমিয়ে পড়ার পর শ্বাসকষ্টে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। এই শ্বাসকষ্টের কারণ ফুসফুসে পানি জমা। একপর্যায়ে পায়ে ও পেটেও পানি জমতে পারে।

কিডনি রোগ: কিডনি শরীরে ছাঁকনির কাজ করে। রক্ত পরিশোধন করার জন্য শরীর থেকে অপ্রয়োজনীয় পদার্থ বের করে দেয়। দেহে পানির ভারসাম্য রক্ষা কিডনির কাজ। কিডনি যখন এমন ফিল্টারিংয়ের কাজ ঠিকমতো করতে পারে না, তখন অতিরিক্ত পানি জমে পা ফুলে যায়। কিডনি জটিলতায় প্রথমে মুখটা ফোলা মনে হয়, পরে পা ফুলতে দেখা যায়। ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপে ভোগা রোগীদের কিডনি জটিলতার ঝুঁকি বেশি। তাই পায়ে পানি জমলে কিডনির পরীক্ষা–নিরীক্ষা দরকার। কম বয়সে পা ফোলা, লালচে প্রস্রাব এবং উচ্চ রক্তচাপ দেখা দিলে কিডনির অসুখের আশঙ্কা বেশি।

রক্তনালির অসুখ: শরীরের শিরাগুলো হৃদ্‌যন্ত্রে রক্ত বয়ে আনে। কোথাও রক্ত জমাট বেঁধে এই কাজ বাধাপ্রাপ্ত হলে শরীরের সেই জায়গা ফুলে যেতে পারে। পায়ের বড় শিরায় রক্ত জমাট বাঁধার ঘটনা বেশি ঘটে। এটি ডিপ ভেইন থ্রম্বোসিস বা ‘ডিভিটি’ নামে পরিচিত। ‘ডিভিটি’ হলে কোমর থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত সম্পূর্ণ পা ফুলে যায়। ‘ডিভিটি’তে সাধারণত এক পা ফোলে। শিরায় রক্ত জমাট বাঁধার একটি বড় জটিলতা হলো, ফুসফুসের শিরায় এই জমাট রক্ত প্রবাহিত হয়ে মারাত্মক অবস্থা তৈরি করতে পারে। ঘন শ্বাসপ্রশ্বাস, শ্বাসকষ্ট এবং বুকে ব্যথা—এই জটিলতার লক্ষণ। তাই এক পা ফুললে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন।

যকৃতের রোগ: যকৃৎ বা লিভারের সমস্যা যেমন সিরোসিস হলে প্রথম দিকে পেটে ও পরে পায়ে পানি জমতে পারে। এ ধরনের রোগীদের খাবারে অরুচি, হলুদ প্রস্রাব, রক্ত বমি হতে পারে।

হরমোনের সমস্যা: শরীরে থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা কমে গেলে পায়ে পানি আসতে পারে। এতে এই উপসর্গ ছাড়াও রোগীর শীত শীত ভাব, ক্লান্তি, ওজন বৃদ্ধি, মাসিকের রক্ত বেশি যাওয়া, কোষ্ঠকাঠিন্যের মতো উপসর্গ থাকতে পারে। হাইপোথাইরয়েডিজমে ফুললেও তা আঙুলের চাপেও দেবে যায় না। বরং খসখসে মনে হয়।

গর্ভাবস্থা: গর্ভাবস্থার শেষ চার মাস সময়ে অনেকের পা ফুলতে পারে। এ সময় রক্তচাপ মেপে দেখা, প্রস্রাব পরীক্ষা করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। গর্ভকালীন জটিলতা এড়াতে এ সময় পা ফুললে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকতে হবে।

ফাইলেরিয়া: ফাইলেরিয়া নামের একধরনের কৃমি সংক্রমণ থেকে পা ফুলতে পারে।

যা করবেন

সাধারণ পা ফোলায় বালিশে পা রেখে ঘুমালে এবং পা তুলে বসার অভ্যাসে দু–এক দিনের মধ্যেই তা সেরে যায়। যাঁরা দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে কাজ করেন, কাজের ফাঁকে তাঁদের একটু হাঁটাহাঁটি করা উচিত। দীর্ঘ সময় পা ঝুলিয়ে বসার অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। উচ্চতা অনুযায়ী শরীরের ওজন ঠিক রাখতে হবে। দীর্ঘ ভ্রমণে পায়ের পাতা, আঙুল ও পেশি সচল থাকে, এমন ব্যায়াম করা যেতে পারে। মাঝেমধ্যে আসনের ওপর পা তুলে বসা যেতে পারে। দু-এক দিনে ফোলা না কমলে এবং সঙ্গে অন্য কোনো উপসর্গ থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। চিকিৎসক আপনার পা ফোলার কারণ খতিয়ে দেখবেন এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা দেবেন। যাঁরা নিয়মিত ব্যথানাশক ওষুধ, উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ বা জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য ওষুধ সেবন করছেন, তাঁরা সেগুলো চিকিৎসককে জানান। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া পা ফোলা কমাতে শরীরের পানি কমানোর ওষুধ খাবেন না। তাতে রক্তের ইলেকট্রোলাইট বা খনিজ লবণ কমে গিয়ে অন্য বিপদ বাধতে পারে।