>আমাদের শরীর একটা দেহঘড়ি। তাতে সব সময় টিকটিক করে শব্দ করে চলেছে একটি কাঁটা, যাকে আমরা হৃৎপিণ্ড বলি। মানবদেহের সবচেয়ে সক্রিয় অংশ। নিজের হৃৎপিণ্ড সম্পর্কে তাই ভালোভাবে জেনে রাখা জরুরি। আসুন, জেনে নিই বাংলাদেশে কোন ধরনের হৃদ্রোগ বেশি হয়ে থাকে। লিখেছেন ডা. মনোজ কুমার সরকার
বাংলাদেশে হৃদ্রোগীদের বয়সভিত্তিক শ্রেণিবিভাগ করলে বিষয়টি সহজে বোধগম্য হয়। রোগের ধরন সম্পর্কে আলোচনার আগে জাতীয় হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউটের চিকিৎসার ধরন সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোকপাত করা প্রয়োজন। রক্তচাপ, বুকে ব্যথা বা হৃদ্রোগ-সংক্রান্ত যেকোনো রোগীদের চিকিত্সা দেওয়া হয়। প্রয়োজনে রোগীদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখে ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী রোগ নিরূপণ করে ভর্তির ব্যবস্থা নেওয়া হয় বা ছুটি দেওয়া হয়। হৃদ্রোগ নয়, এমন রোগীদের অন্যত্র ‘রেফার্ড’ করা হয়।
আমাদের দেশে হৃদ্রোগের ধরন অনুযায়ী রোগীদের নিম্নোক্তভাবে বিন্যাস করা যেতে পারে:
(ক) শিশু রোগী বা অপ্রাপ্ত বয়স্ক রোগী
(খ) প্রাপ্ত বয়স্ক রোগী।
শিশু রোগীদের মধ্যে অধিকাংশের হৃৎপিণ্ডের ত্রুটিই জন্মগত। এর মধ্যে (ক) VSD (Ventriculor Septel defect) (খ) ASD (Atrial Septal Defect) (গ) PDA (Potent ductus Arteriosus) (ঘ) TOF (Tetralogy of Fallots (ঙ) DORV. (Double out let Rt. Ventricl) (চ) TGA (Transposition of Great Vessels (ছ) Pulmona Atresia Agenasia: Stenosis ও অন্যান্য।
শিশু রোগীদের রোগ সঠিকভাবে নির্ণয় করতে শিশু কার্ডিওলজি বিভাগে নানাবিধ পরীক্ষা করে থাকেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা। সম্ভব হলে অপারেশন ছাড়াই ডিভাইসের মাধ্যমে হৃৎপিণ্ডের ছিদ্র বন্ধ করা হয়। সম্ভব না হলে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ত্রুটি ঠিক করতে রোগীকে পাঠানো হয় শিশু কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগে। বিশেষজ্ঞ কার্ডিয়াক সার্জন (শিশু) অপারেশন করেন। গর্বের বিষয়, জাতীয় হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউটে অস্ত্রোপচারে সাফল্যের হার ঈর্ষণীয়, যা পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশের সঙ্গে তুলনীয়।
প্রাপ্ত বয়স্ক রোগীদের মধ্যে একটি অংশ যারা ছোটবেলা থেকেই জন্মগত হৃদ্রোগে ভুগছেন, পরবর্তী সময়ে আর চিকিত্সা করাননি বা করতে পারেননি। দ্বিতীয় অংশের রোগীরা বয়স বাড়ার সঙ্গে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে বেশির ভাগের হৃৎপিণ্ডের রক্তনালিতে ‘ব্লক’ সৃষ্টি হয়, যার পরিপ্রেক্ষিতে রোগী বুকের ব্যথা (Angina) বা ‘হার্ট অ্যাটাক’ (Myocardial in fraction) নিয়ে আসেন। অন্যান্য জটিলতাও থাকে যেমন ‘হার্ট-ফেইলুর’—যার পরিপ্রেক্ষিতে বুকে পানি আসে ও শ্বাস নিতে অসুবিধা হয়। হার্টের গতির ছন্দের ব্যাঘাত ঘটে (Arrythmia)। এ জন্য রোগী অস্থিরতা বোধ করেন এবং অজ্ঞান পর্যন্ত হতে পারেন। রক্তনালির ‘ব্লকে’ রোগী সুচিকিৎসা না পেলে পরবর্তীকালে তাঁদের ‘কার্ডিওমাইওপেথি’ বা হৃৎপিণ্ডের মাংসপেশির মারাত্মক দুর্বলতা তৈরি হয়।
রক্তনালির অসুখের পাশাপাশি হৃৎপিণ্ডে ভালভের সমস্যায়ও ভুগে থাকেন রোগীরা।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে হৃদ্রোগের মধ্যে অন্যতম ভালভ আক্রান্ত হওয়া বা নষ্ট হওয়া। বাতজ্বর থেকে এই রোগের পরিণতি ‘রিউম্যাটিক ভাসকুলার হার্ট ডিজিজ’, যার পরিপ্রেক্ষিতে রোগী হৃৎপিণ্ডের ভালভ ক্রমাগত কর্মক্ষমতা হারিয়ে একপর্যায়ে সম্পূর্ণ অকার্যকর হয়ে পড়ে। তখন রোগীর জীবনধারণ করা ভীষণ কষ্টকর। এ পর্যায়ে ভালভ পরিবর্তন করতে অপারেশন প্রয়োজন হয়। বর্তমানে অপারেশন ছাড়াও ভালভ পরিবর্তন করা হলেও সেটা ভীষণ ব্যয়বহুল।
গত বছর জাতীয় হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউটের বহির্বিভাগ ও জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নেওয়া মোট রোগীর সংখ্যা ২ লাখ ২৬ হাজার ১৩৪ জন। এর মধ্যে পুরুষ রোগীর সংখ্যা ১ লাখ ৪৬ হাজার ১৭৭ এবং নারী রোগীর সংখ্যা ৬৮ হাজার ৩২৪ জন। শিশু রোগী ১১ হাজার ৬৩৩ জন। এসব রোগীর মধ্যে ভর্তি হয়েছেন ৬৪ হাজার ৯০৬ জন এবং চিকিত্সা শেষে সুস্থ হওয়া রোগীর সংখ্যা ৬৩ হাজার ৬৫৮। মারা গেছেন ৪ হাজার ৫৫ জন।
বিবিধ সীমাবদ্ধতা ও প্রতিকূলতার পরও বাংলাদেশ সরকার হৃদ্রোগের সুচিকিৎসার জন্য আন্তরিক ও উদ্যোগী। সব স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সার্বিক প্রয়াসে জাতীয় হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউটে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের সেবাদানে ২৪ ঘণ্টা নিরলস কাজ করে যেতে বদ্ধ পরিকর।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউট