দাম্পত্যে ঝগড়া কিন্তু খারাপ নয়

স্বাস্থ্যবিষয়ক চিকিৎসা পরামর্শ নিয়ে ডিজিটাল হসপিটালের সরাসরি অনুষ্ঠান ‘ডিজিটাল হসপিটাল লাইভ: হ্যালো ডক্টর’। ১৪ অক্টোবর অনুষ্ঠিত এর নবম পর্বের বিষয় ছিল ‘করোনাকালের দাম্পত্য সম্পর্ক’। এতে দর্শকদের প্রশ্নের উত্তর দেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এশিয়ান সোসাইটি অব সেক্সুয়াল মেডিসিনের সভাপতি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. শামসুল আহসান মাকসুদ। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন শ্রাবণ্য তৌহিদা।

এ অনুষ্ঠানে বলা হয়, করোনা মহামারিকালে দাম্পত্য কলহ অনেকটাই বেড়েছে। কারণ, একসঙ্গে অনেক সময় থাকলে যে খুঁটিনাটি ভুল চোখে পড়ে, এটা–সেটা নিয়ে লেগে যায়। অনেকেই এগুলো এড়িয়ে চলতে পারেন না। তবে সম্পর্ক যে আগের চেয়ে ভালো হয়েছে, এমনটাও আছে। হয়তো অনেকে ঘরে সময় দিতে পারতেন না, হোম অফিস চলার কারণে একজন আরেকজনকে একটু সময় দিতে পেরেছেন। অনেক দিন ধরে করা হয় না, এমন পড়ে থাকা কাজগুলোও হয়েছে। তবে এটা দাম্পত্যকলহের তুলনায় কম। তবে যতই সম্পর্ক উষ্ণ হোক না কেন, কত দিন আর ঘরে আটকে পড়ে থাকা যায়!

ডা. মো. শামসুল আহসান জানান, সাধারণভাবে গ্রীষ্মপ্রধান দেশের চেয়ে শীতপ্রধান দেশে বিষণ্নতা বেশি। কেননা, দিনের আলো না দেখলে, গায়ে রোদ না লাগলে বিষণ্নতা, হাতাশা কাজ করে। করোনায় আমরা ঘরের ভেতরে যখন ছিলাম, তখনো আমাদের অস্থিরতা বেড়েছে। বাচ্চাদের ইন্টারনেট, গেম এগুলোর প্রতি আসক্তি বেড়েছে। এটা মা–বাবাকেও প্রভাবিত করেছে। একটা পরিবার হলো একটা মুক্তোর মালার মতো। এর কোনো একটা মুক্তোয় সমস্যা হলে পুরো মালাকে প্রভাবিত করে। পরিবারও তাই। যেকোনো একজন ‘ডিস্টার্বড’ থাকলে তা অন্য সবাইকে প্রভাবিত করে।

অতিথি ডা. মো. শামসুল আহসান মাকসুদ, সঞ্চালক শ্রাবণ্য তৌহিদা
ছবি: সংগৃহীত

এ আলোচনায় আরও উঠে আসে মহামারিকালে শরীর ও মন ভালো রাখতে পর্যাপ্ত গভীর ঘুমের কোনো বিকল্প নেই। ঘুম রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাপকে (ইমিউন সিস্টেম) ভালো রাখে। ব্যায়াম করতে হবে। সেটা মনকে চাঙা রাখবে। সুষম খাদ্যাভ্যাসও সমান জরুরি। জাংক ফুড, কোমল পানীয়—এগুলো একধরনের অস্থিরতা তৈরি করে। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যায়। নিজের জন্য ব্যক্তিগত জায়গা রাখতে হয়। আর দাম্পত্য সম্পর্কে একজন আরেকজনকে সেই জায়গাটুকু দিতে হয়, শ্রদ্ধাশীল থাকতে হয়। নিজের সঙ্গ উপভোগ করা জরুরি। সম্পর্কে কৌতূহল বজায় রাখতে হয়। দাম্পত্য সম্পর্কেও একজন আরেকজনকে প্রতিনিয়ত চমকে দিতে হয়। খুশি রাখতে হয়। আলাদা করে ভাবতে হয়। জীবনে নতুনত্ব জরুরি। যখন দুজন মানুষ প্রেম করে, তখন কৌতূহল থাকে। ডোপামিন নিঃসৃত হয়। আর ভালো লাগে। বিয়ের পর অক্সিটোসিন হরমোন বেশি নিঃসৃত হয়। কিন্তু ডোপামিন কমে যায়। এই দুইয়ের ভারসাম্য রাখতে হয়। না হলে দাম্পত্যকলহ তৈরি হয়। তাই দাম্পত্য সম্পর্কে কৌতুহল জারি রাখতে হবে।

মহামারিকালে দাম্পত্যকলহ, বিচ্ছেদ অনেক বেড়েছে। বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত ভেবেচিন্তে নেওয়া উচিত। কোনো কিছু দ্বারা তাড়িত হয়ে হুট করে সিদ্ধান্তে যাওয়া ঠিক না। ‘হিট অব দ্য মোমেন্ট’–এ নেওয়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করার আগে একজন ম্যারেজ কাউন্সিলরের অধীনে থাকা উচিত। বিষণ্নতা, অস্থিরতা, হতাশা—এগুলো দ্বারা তাড়িত হয়ে হুট করে কিছু করে ফেলা যাবে না। দাম্পত্য সম্পর্কে একজন যখন রেগে আগুন হয়ে যাবেন, আরেকজনকে তখন সেখানে পানি ঢালতে হবে। দুপক্ষেরই সম্পর্কের উন্নয়নের জন্য সমান দায়িত্বশীল হতে হবে। একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। সম্পর্কটা প্রতিনিয়ত নতুন রাখতে হয়। দাম্পত্য সম্পর্ককে ‘টেকেন ফর গ্রান্টেড’ হিসেবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

অতিথি ডা. মো. শামসুল আহসান মাকসুদ, সঞ্চালক শ্রাবণ্য তৌহিদা
ছবি: ফেসবুক লাইভ থেকে নেওয়া

ডা. মো. শামসুল আহসান বলেন, প্রচণ্ড রেগে গেলে ‘ফোর ডি থিওরি’ রাখতে হবে—‘ড্রিংক কোল্ড ওয়াটার, ডাইভার্ট ইয়োর মাইন্ড, ডিলে অ্যান্ড ডিপার্ট।’ যখনই প্রচুর রাগ হবে, আপনি গোসল করতে পারেন। ঠান্ডা পানি পান করতে পারেন। অন্য কোনো কিছুতে মনোযোগ দিন। ওই মুহূর্তে তাড়িত হয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন না। কোনো কথাই বলবেন না। হিট অব দ্য মোমেন্টে অন্যকে আহত করে কিছুই বলবেন না। ২৪ ঘণ্টা পরে যা বলার বলবেন। সিদ্ধান্ত নেবেন।  

হয়তো একজন আপনাকে রাগানোর চেষ্টা করছে, আপনি এমন কিছু করবেন, যেটা সে আশা করেনি। আপনি মোটেই রাগবেন না। বরং খুবই ভালো আচরণ করেন। তাঁকে চমক দিন। ঝগড়া করা কিন্তু খারাপ নয়। ছোটখাটো ঝগড়া বা মনোমালিন্যের পর সাধারণত সম্পর্কের বন্ধন বাড়ে। একটা পরিবর্তন আসে। কৌতূহল বাড়ে। নতুনত্ব আসে। ডোপামিন নিঃসৃত হয়। মনে হয় এরপর কী? তাই এসব নিরীহ, টুকটাক ঝগড়া করা খারাপ নয়। সেটা একটা নতুনত্ব, অভিনবত্ব আনে। সম্পর্ককে একটা মাত্রা দেয়, মোড় নেয়। তবে ঝগড়াটা যেন কোনোভাবেই মাত্রা ছাড়িয়ে না যায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।