কানের সমস্যায় আকুপ্রেশার
আধুনিক জীবনযাপনে কানে ডিভাইস দিয়ে কথা শোনা, গান শোন, ভিডিওতে আসক্তিতে কানের নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। সেই সঙ্গে নগর জীবনে শব্দদূষণ তো আছেই। কান একটি সংবেদনশীল অঙ্গ, যার কারণে খুব অল্পতেই কানের নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। কানের সমস্যা হলে এবং কানের সমস্যা হতে না দিতে চাইলে নিয়মিত আকুপ্রেশার করে কান ঠিক রাখা যেতে পারে।
কানের সমস্যা বহু ধরনের হতে পারে। এই যেমন টনসিল বা সাইনাসের সমস্যার কারণে কারও কারও কানে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভূত হয়, কানের ভেতর হওয়া প্রদাহের কারণেও শ্রবণক্ষমতা হ্রাস পায়, অনেকক্ষণ উচ্চ আওয়াজ শোনাও কানের জন্য ভীষণ বিপদ ডেকে আনতে পারে, বিভিন্ন ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণেও শ্রবণক্ষমতা চিরতরে বা কিছু সময়ের জন্য হারিয়ে যেতে পারে, কানে ভোঁ ভোঁ শব্দ হয়ে কানের বড় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে বলে আগাম জানান দেয়। ধীরে ধীরে কানে কম শোনা মানুষ বুঝতে পারে না। যখন চূড়ান্তভাবে শব্দ কম শোনে, তখন ডাক্তার থেকে হাসপাতালে ছোটাছুটি করেও সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হয় না।
শিশুদের কানের ইনফেকশন অন্যতম একটি ভয়াবহ সমস্যা, কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো, শিশুদের কানের সমস্যা মা–বাবারা এটিতে খুব একটা নজর দেন না আর এটাকে নিতান্তই মামুলি ব্যাপার বলে মনে করে। কানের ইনফেকশন শিশুর জন্য মোটেও সাধারণ কোনো ব্যাপার নয়। কানের ইনফেকশন থেকে বাচ্চা সারা জীবনের মতো বধির হয়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশের প্রায় দেড় কোটি মানুষ কোনো না কোনো মাত্রায় বধিরতায় ভুগছে। কানের সমস্যা আছে, এমন পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের ৪০ শতাংশের জন্মগতভাবে কানে সমস্যা থাকে, ১৮ শতাংশ সমস্যা হয় সংক্রমণের কারণে, ৮ শতাংশের সমস্যা হয় ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায়। বাকিদের সমস্যার পেছনে রয়েছে কান খোঁচাখুঁচিসহ আরও বেশ কিছু কারণ।
কান যেভাবে কাজ করে
শব্দতরঙ্গ পিনায় বাধাপ্রাপ্ত হয়ে বহিঃঅডিটরি মিটাসে প্রবেশ করে টিমপেনিক পর্দাকে আঘাত করলে সেটা কেঁপে ওঠে। কাঁপনে মধ্যকর্ণে অবস্থিত ম্যালিয়াস, ইনকাস ও স্টেপিস অস্থি তিনটি এমনভাবে আন্দোলিত হয়, ফলে প্রথমে ফেনেস্ট্রা ওভালিসের পর্দা ও পরে অন্তঃকর্ণের ককলিয়ার পেরিলিম্ফে কাঁপন সৃষ্টি হয়। পেরিলিম্ফে কাঁপন হলে ককলিয়ার অর্গান অব কর্টির সংবেদী রোমকোষগুলো উদ্দীপ্ত হয়ে স্নায়ু আবেগের সৃষ্টি করে। এ আবেগ অডিটরি স্নায়ুর মাধ্যমে মস্তিষ্কের শ্রবণকেন্দ্রে বাহিত হলে মানুষ শুনতে পায়। দেহের ভারসাম্য রক্ষা করাও কানের অন্যতম একটি কাজ। আকুপ্রেশারের মাধ্যমে আমাদের কানে তরঙ্গ প্রবাহ ঠিক রাখতে সাহায্য করে।
কানের সাধারণ সমস্যায় আকুপ্রেশার
যাঁরা কলেস্টিয়েটমা আক্রান্ত, তাঁরাও আকুপ্রেশার করতে পারবেন। এটি কানের একটি ক্রনিক বা দীর্ঘমেয়াদি ইনফেকশন, যা কানের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলোকে নষ্ট করে দেয়, কান কখনো শুকায় না, প্রায়ই কানে ব্যথা থাকে এবং কানের শ্রবণক্ষমতা দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। একসময় এ সমস্যা অন্তঃকর্ণে (কানের ভেতরের অংশ) চলে গেলে তীব্র মাথা ঘোরা শুরু হয়। এই জন্য প্রথমে দুই হাতের আঙুলের ওপরে ছবিতে দেওয়া পয়েন্টে আকুপ্রেশার করুন। প্রতিটি আঙুলে ১০০টি করে চাপ দেবেন, ১০ আঙুলেই ১০০ করে চাপ দিতে হবে।
কানের অভ্যন্তরে হিয়ারিং সেল নষ্ট হয়ে গেলে শ্রবণক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এটি বার্ধক্যজনিত কারণে হওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের মুঠোফোনকেন্দ্রিক জীবনযাপনের কারণে অনেক কম বয়সী মানুষের শ্রবণক্ষমতা কমে গেছে।
কানে সঠিকভাবে শুনতে পাচ্ছেন না, এই যেমন সবার সঙ্গে টিভিতে কোনো অনুষ্ঠান দেখতে বসে বারবার টিভির ভলিউম বাড়িয়ে দিতে বলছেন কিংবা মিটিংয়ে একটু পেছনে বসে বক্তার আওয়াজ আপনার কানে ঠিকমতো এসে পৌঁছাচ্ছে না। হাতের কনিষ্ঠ আঙুলে নিচের দিকে দুই হাতেই পয়েন্টে ১০০ বার করে চাপ দেবেন।
কানের অন্যতম সাধারণ সমস্যা হলো বহিঃকর্ণে প্রদাহের সৃষ্টি হওয়া। যেকোনো বয়সেই এ সমস্যার উদ্ভব হতে পারে; তবে শিশুদের এ সমস্যা বেশি হয়। মূলত কানে ময়লা জমে যাওয়া এবং সেটা নিয়মিত পরিষ্কার না করা হলে বহিঃকর্ণে প্রদাহ দেখা দেয়। কানের খৈল বা ওয়াক্সের সঙ্গে ধুলাবালু জমেও প্রদাহের সৃষ্টি হতে পারে। ময়লা পরিষ্কার করার জন্য অনেকেই কটনবাড ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু কটনবাডে লেগে থাকা ময়লা কানে প্রবেশ করেও কানে ইনফেকশন দেখা দিতে পারে।
ইনফেকশন এড়াতে হলে আকুপ্রেশার করতে হবে। এর জন্য হাতের অনামিকা নিচের দিকে দুই হাতেই পয়েন্টে ১০০ বার করে চাপ দিতে হবে।
সবার শেষে দুই হাতের উপরিভাগে কড়ে আঙুলের কার্ভের জায়গা লম্বালম্বিভাবে চাপ দিন, এখানে ঘাড়ের সমস্যাজনিত কারণে আকুপ্রেশার করা হয়, সেটাও কানের জন্য জরুরি। তাই এখানে ১০০ করে চাপ দেবেন।
আকুপ্রেশার করার জন্য সকালে ঘুম থেকে উঠে এবং রাতে শোয়ার আগে উত্তম সময়, এ ছাড়া খালি পেটে সব সময়ই আকুপ্রেশার করা সম্ভব। আকুপ্রেশার করার জন্য কোনো নির্দিষ্ট আসন করার প্রয়োজন নেই, বসে কিংবা শুয়ে আকুপ্রেশার করতে পারবেন।
বিভিন্ন কারণে কান পচা রোগ দেখা হয়। দুই ধরনের কান পচা রোগ আছে। একটি তুলনামূলক কম বিপজ্জনক, আরেকটি বেশি বিপজ্জনক। পানি বা অন্য কিছুর কারণে কানের পর্দা ছিদ্র হয়ে গেলে কান পচা রোগ দেখা দেয়। এ ছাড়া আমাদের কানের ভেতরে অবস্থিত ছোট ছোট হাড় আছে। সেগুলো ক্ষয় হয়ে গেলেও এ সমস্যা হতে পারে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় মধ্যকর্ণে কলেস্টিটোমার উপস্থিতির কারণে। এটি একধরনের ক্ষতিকর অবাঞ্ছিত পাতলা আবরণ, যা মধ্যকর্ণে সৃষ্টি হয়। এই সমস্যাগুলো আকুপ্রেশার দিয়ে ঠিক করা যাবে না। ঠিক সময়ে অপারেশনের মাধ্যমে শ্রবণশক্তি ৭০-৮০ শতাংশ পর্যন্ত ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এ ছাড়া কম বিপজ্জনক কান পচা রোগ (কলেস্টিটোমার উপস্থিতি ছাড়া) বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ওষুধের মাধ্যমে নিরাময় করা সম্ভব। কোনোভাবেই বিলম্ব করা ঠিক নয়।
লেখক: খাদ্যপথ্য ও আকুপ্রেশার বিশেষজ্ঞ
ছবি: লেখক