করোনা নামের অদৃশ্য দানবের তাণ্ডবে বিশ্বে এ পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন ২০ লাখেরও বেশি মানুষ। তাঁদের ভেতর বেশির ভাগই বয়স্ক, যাঁরা আগে থেকেই হৃদ্রোগ, কিডনি রোগ, ক্যানসারের মতো জটিল রোগে ভুগছিলেন। শিশুদের মৃত্যুহার অনেক কম। আবার এর ভেতর করোনার নতুন ধরনের স্ট্রেইনের আগমনে শিশুদের নিয়ে দেখা দিয়েছে নতুন আশঙ্কা। এ সময় আমাদের কী করণীয়, তা নিয়ে আলোচনা হলো ‘ডিজিটাল হসপিটাল লাইভ: হ্যালো ডক্টর’–এর সপ্তম পর্বে।
ডা. শ্রাবণ্য তৌহিদার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে ছিলেন কুমুদিনী উইমেনস মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিপার্টমেন্ট অব পেডিয়াট্রিকসের সহকারী অধ্যাপক ফারজানা আফরোজ। অনুষ্ঠানটি ২১ জানুয়ারি প্রথম আলো ও ডিজিটাল হসপিটালের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজ থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।
ডা. ফারজানা আফরোজ বলেন, ‘আমাদের ভেতর শুরু থেকেই একটা ভুল ধারণা ছিল যে কোভিড–১৯-এ বাচ্চারা আক্রান্ত হয় না। তারা আক্রান্ত হচ্ছে, তবে টেস্ট কম হচ্ছে দেখে সঠিক সংখ্যাটা জানা যাচ্ছে না। আর বাচ্চাদের টেস্ট কম করানোর কারণ, তাদের ভেতর কোভিড–১৯-এর উপসর্গগুলো খুব মৃদু আকারে থাকে। তাই সবাই ধরে নিচ্ছে যে তারা সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত এবং সাধারণ সর্দিকাশির চিকিৎসা করালেই তা সেরে যাচ্ছে। বড় কোনো মারাত্মক সমস্যা হচ্ছে না।’
ডা. ফারজানা আফরোজ বলেন, ‘যেহেতু স্কুল–কলেজ বন্ধ, সেহেতু বাচ্চারা খুব কম বাইরে বের হচ্ছে। কিন্তু তারা কোভিডে আক্রান্ত হচ্ছে তাদের মা-বাবার মাধ্যমে।’ তাই মা–বাবাকেই আগে সতর্ক হয়ে সব রকমের স্বাস্থ্যবিধি মেনেই চলাফেরা করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
এ ছাড়া তিনি রোগ প্রতিরোধ নিয়েও কথা বলেন। এটি দুই রকম। একটি হচ্ছে ভেতর থেকে ভাইরাসের বিরুদ্ধের লড়াইয়ের জন্য শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা থাকা। আরেকটি হলো বাইরে থেকে ভাইরাসটি ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে, সেই ব্যবস্থা নেওয়া। শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার জন্য খাদ্যাভাসের দিকে নজর দিতে হবে। এ জন্য শিশুদের পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতে হবে। আর বাবা-মায়েরা নিজেরা সুরক্ষিত থাকার পাশাপাশি, শিশুদের সুরক্ষিত রাখার জন্য তাদের মাস্ক পরার আর বারবার হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে সাহায্য করতে হবে।
রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার একটি বড় অংশ হচ্ছে শারীরিক কার্যকলাপ। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে স্কুল বন্ধ থাকায় এটি এখন অনেক কমে গেছে। করোনার জন্য বাইরেও খেলতে যেতে পারছে না। এতে বাচ্চার শারীরিক ও মানসিক বিকাশ এবং রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। টেলিভিশন, কম্পিউটার, স্মার্টফোন, ট্যাবে বেশি সময় কাটাচ্ছে। ফলে নতুন করে তাদের চোখ, কান এবং মনোযোগের অভাবের মতো সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এসব সমস্যা এড়াতে বাবা-মাকে এগিয়ে আসার পরামর্শ দেন ডা. ফারজানা আফরোজ। বাচ্চারা যাতে বাসায় অ্যাকটিভ থাকে, তার ব্যবস্থা অভিভাবককেই নিশ্চিত করতে হবে।
সবার মতো বাচ্চারাও এই কোভিড পরিস্থিতিতে অনেক আতঙ্কিত হয়ে আছে। তাই এ সময় অভিভাবকদের উচিত তাদের সঙ্গে বেশি সময় কাটানো। খেলাধুলা করা, গল্প করা বা বই পড়ে শোনানো।
ডা. ফারজানা আফরোজ বলেন, ‘সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জার উপসর্গের সঙ্গে কোভিডের মৃদু উপসর্গের খুব একটা পার্থক্য না থাকার কারণে, কোনো শিশুর জ্বর, সর্দিকাশি, ডায়রিয়া, ঘ্রাণশক্তি ও মুখের স্বাদ চলে যাওয়া ইত্যাদি দেখা দিলেই অভিভাবকদের উচিত করোনা টেস্ট করিয়ে নেওয়া।’ এ ধরনের সমস্যা দেখা দিলে উপসর্গ বুঝে ব্যবস্থা নিতে হবে। এরপর যদি দেখা যায় বাচ্চার শ্বাসকষ্ট ও অতিমাত্রায় দুর্বলতা দেখা দিয়েছে বা কাউকে চিনতে পারছে না, এ রকম মারাত্মক অবস্থা দেখা দিলে তাকে অবশ্যই হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
বাচ্চাদের শরীরের শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য পুষ্টিকর খাবারের কোনো বিকল্প নেই। তবে সব সময় হিসাব করে পুষ্টিকর খাবার খাওয়া সম্ভব হয় না। অন্যদিকে যে খাবারগুলো খেলে শরীরে ক্ষতি হতে পারে, সেগুলো কিন্তু চাইলে এড়ানো যায়। অতিরিক্ত চিনি এবং লবণযুক্ত প্যাকেট বা টিনজাত খাবার, জাঙ্কফুড বর্জন করে বা সীমিত পরিমাণে দিয়ে বাচ্চাদের ঘরের তৈরি পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানোর অভ্যাস করতে হবে। তাদের জন্য আলাদা খাবার না বানিয়ে ঘরে অন্য সদস্যরা যে খাবার খায়, সেটাই খাওয়ানোর প্রতি জোর দিয়েছেন ডা. ফারজানা আফরোজ।
অনেক মা আছেন যাঁরা বাচ্চাদের টিভি বা ইউটিউবে কার্টুন দেখিয়ে খাবার খাওয়ান। এতে বাচ্চারা খাবার না দেখে খাচ্ছে। ফলে তাঁদের মুখে লালা নিঃসৃত হচ্ছে না, যাতে হজমক্রিয়া ব্যাহত হয়। হজমক্রিয়া ব্যাহত হওয়ার ফলে অনেক বাচ্চার পেটে সমস্যা দেখা দেয়। অন্যদিকে বাচ্চাদের একটি ডিভাইসের প্রতি আসক্তি হচ্ছে, যা মানসিক বিকাশের জন্য অন্তরায়। তাই বাবা–মায়েদের এ ব্যাপারে অনেক সতর্ক থাকতে হবে। কষ্ট হলেও শিশুর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ডিভাইস না দেখিয়ে, পরিবারের সবার সঙ্গে বসে খাবার খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে সহায়তা করতে হবে।