এই সময়ে শিশুর রোগবালাই
বর্ষা এসে গেল—আকাশে মেঘের আনাগোনা, হঠাৎ বৃষ্টি, মাঝেমধ্যে তীব্র গরম। বাতাসে আর্দ্রতা অনেক বেশি। ফি বছর এ সময়টাতে শিশুরা নানা রোগবালাইয়ে ভোগে। মৌসুমি জ্বরজারি, সর্দি-কাশি, ডায়রিয়া হওয়া অস্বাভাবিক নয় এ সময়। কিন্তু এ বছরটা যে একেবারে আলাদা। এবার আপনি চাইলেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাসপাতালে যেতে পারছেন না। চিকিৎসকের চেম্বার বা ক্লিনিকে যাওয়া নিরাপদ মনে করছেন না। আবার জ্বর-কাশি হলে আঁতকে উঠছেন—করোনা হলো না তো? এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শিশুদের এসব সমস্যা মাথা ঠান্ডা রেখে সামাল দিতে হবে। যতটা সম্ভব বাসায় রেখে শিশুর যত্ন নিতে হবে, চিকিৎসা দিতে হবে।
নবজাতকের স্বাস্থ্য নজরদারি
এই সময়ের নবজাতকদের একটা পরিচিত সমস্যা নাক বন্ধ থাকা। নাক বন্ধের জন্য শিশু শ্বাস নিতে পারছে না, দুধ টেনে পান করতে পারছে না, নাকে শব্দ হচ্ছে, বুকে শব্দ হচ্ছে। মায়েদের বলছি, এতে ভয় পাবেন না। এই সমস্যাটি অতি সাধারণ—সব শিশুরই হয়। নাক বন্ধ থাকলে লবণপানির ড্রপ বা নরসল/ন্যাসোমিস্ট ড্রপ ২ ফোঁটা করে ২ নাকে দিয়ে কটন বাড দিয়ে নাক মুছে দিন। যতবার প্রয়োজন, ততবারই এটি ব্যবহার করতে পারেন। এটা কোনো ওষুধ নয় এবং ব্যবহারে শিশুর কোনো ক্ষতি হবে না।
নাক বন্ধের সঙ্গে শিশুর জ্বর-কাশি থাকলে খেয়াল করুন শিশু ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে কি না (মিনিটে ৬০ বার বা তার বেশি), তার বুকের পাঁজরের নিচের অংশ ভেতরে দেবে যাচ্ছে কি না। যদি তা হয়, তাহলে বুঝতে হবে শিশু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত। সে ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক লাগবে। কিন্তু ভুলেও পাড়ার দোকান থেকে অ্যান্টিবায়োটিক বা কাশির ওষুধ কিনে শিশুকে খাওয়াবেন না। এতে শিশুর ক্ষতি হতে পারে। বরং পরিচিত চিকিৎসককে ফোন দিন বা যেখানে টেলিমেডিসিন চালু আছে, সেখান থেকে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। সংক্ষেপে শিশুর সমস্যা খুলে বলুন, আপনার পর্যবেক্ষণগুলো বর্ণনা করুন। এরপর চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন অনুসারে ওষুধ খাওয়ান।
যদি এর সঙ্গে শিশু নিস্তেজ হয়ে যায়, খাওয়া ছেড়ে দেয়, জ্বর থাকে, খিঁচুনি হয়, নীল হয়ে যায় বা ঠান্ডা হয়ে যায়—তাহলে দ্রুত কাছের হাসপাতালে নিয়ে যান।
ঠান্ডা লাগার ভয়ে বৃষ্টি–বাদলার দিনে অনেকে শিশুকে গোসল করান না। শিশু সুস্থ থাকলে প্রতিদিন হালকা গরম পানি দিয়ে গোসল করান। নবজাতক বুকের দুধ পান করায় অনেক সময় তাদের নরম, পানির মতো বা সবুজ পায়খানা হয়। ২৪ ঘণ্টায় ২৪ বারও পাতলা পায়খানা হতে পারে। এটি কিন্তু ডায়রিয়া নয়—মায়ের দুধে ল্যাক্টোজের পরিমাণ বেশি থাকাতে এমনটি হয়। এ ক্ষেত্রে নবজাতককে বুকের দুধ পান করানো কখোনই বন্ধ করবেন না।
গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো মাকেও সুস্থ থাকতে হবে। মাকে সব ধরনের খাবার খেতে দিন। মা সুস্থ থাকলেই শিশু পর্যাপ্ত দুধ পাবে, শিশুও সুস্থ থাকবে। ছয় মাস পর্যন্ত শুধু বুকের দুধ খাওয়ান। ছয় মাস থেকে শিশুকে পরিবারের খাবার দিতে চেষ্টা করুন। পরিবারে দুগ্ধদানকারী মা থাকলে তাঁর এই সময় সব ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা উচিত বেশি করে।
যাদের বয়স ৬ মাসের বেশি
এই আবহাওয়ায় ছয় মাসের বেশি বয়সের শিশুরাও প্রায়ই সর্দি, কাশি, জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে, মাঝেমধ্যে তাদের ডায়রিয়াও হচ্ছে।
জ্বর হলে প্যারাসিটামল ড্রপ বা সিরাপ দিন। বয়সভেদে বা ওজনভেদে পরিমাণের তারতম্য হতে পারে। ১০ কেজি ওজন বা এক বছর বয়স পর্যন্ত ১৫ ফোঁটা করে দিনে ৩-৪ বার দিন, যদি জ্বর ১০০ ডিগ্রি থাকে। ১৫ থেকে ২০ কেজি হলে ২ চামচ, এর বেশি হলে ৩ চামচ। বারবার তোয়ালে ভিজিয়ে শরীর মুছে দিন।
কাশি থাকলে গরম পানির সঙ্গে মধু-লেবু বা তুলসীপাতার রস-মধু মিশিয়ে খেতে দিন। কাশি বেশি হলে সালবিউটামল–জাতীয় ওষুধ ১ চামচ করে দিনে ৩ বার দিন। অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ কিনে নিজে নিজে খাওয়াবেন না। সাধারণ সর্দি–কাশিতে অ্যান্টিবায়োটিক দরকার হয় না। হুটহাট অ্যান্টিবায়োটিক দিলে পরে মারাত্মক সংক্রমণ হলে তা আর কাজ করে না।
শিশুকে বেশি করে পানি পান করান। ভিটামিন-সি আছে, এমন খাবার বেশি করে দিন, পরিবারের সঙ্গে সব খাবার খেতে দিন। সর্দি–কাশিতে কোনো খাবারে নিষেধ নেই। খেয়াল রাখুন, শিশুর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে কি না, যেমন বুকের পাঁজরের নিচের অংশ ভেতর দিকে দেবে যাচ্ছে কি না, দ্রুত শ্বাস নিচ্ছে কি না (৬-১২ মাস ৫০ বা তার বেশি, ১-৫ বছর ৪০ বা তার বেশি)। সে ক্ষেত্রে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
অনেক কারণে শিশু বমি করে। শিশুর বারবার বমি হলে সিরাপ ওমিডন খাবারের আগে খাওয়ান, শিশুকে জোর করে খাওয়াবেন না।
শিশুর ডায়রিয়া
সারা দিন ৪ বারের বেশি পাতলা পায়খানা হলে ডায়রিয়া বলা যায়। প্রতিবার পায়খানার পর বয়সভেদে ১০ থেকে ২০ চামচ স্যালাইন/রাইস স্যালাইন খাওয়ান। স্যালাইন খাওয়াবেন ধীরে ধীরে। একবারে খাওয়ালে বমি হতে পারে। সঙ্গে কাঁচা কলা সেদ্ধ করে নরম ভাতের সঙ্গে খেতে দিন, তরল খাবার বেশি করে দিন, যেমন ভাতের মাড়, ফলের রস, ডাবের পানি, চিড়ার পানি, টক দই। শিশু বুকের দুধ পান করলে তা বন্ধ করবেন না। অন্য খাবারেও নিষেধ নেই। অনেক পরিবারে শিশুর ডায়রিয়া হলে শিশুকে এমনকি মাকেও বিভিন্ন ধরনের খাবার খেতে দেওয়া হয় না। এটা ঠিক নয়।
লক্ষ করুন শিশুর শরীরে পানিশূন্যতার লক্ষণ আছে কি না। লক্ষণগুলো হলো—
l অস্থির ভাব, খিটখিটে মেজাজ বা নিস্তেজ হয়ে যাওয়া
l চোখ গর্তে ঢুকে যাওয়া
l তৃষ্ণার ভাব বা একেবারেই খেতে না পারা
l চামড়া ঢিলা হয়ে যাওয়া
পানিশূন্যতার লক্ষণ মারাত্মক হলে শিশুকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। তা ছাড়া বমি বেশি হলে, স্যালাইন খেতে না পারলে বা খেয়ে রাখতে না পারলে, অতিরিক্ত পায়খানা হলে, পায়খানার সঙ্গে রক্ত গেলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন।
করোনা নয় তো?
এই সময়ে শিশুর এবং পরিবারের যেকোনো সদস্যের জ্বর হলেই ভয় লাগে—করোনা হয়নি তো? আসলে শিশুদের মধ্যে করোনায় আক্রান্তের হার অনেক কম। আর হলেও বেশির ভাগ শিশুর তেমন লক্ষণ থাকে না। থাকলেও তা খুব মৃদু হয়, যেমন জ্বর, গলাব্যথা, কাশি, মাঝেমধ্যে কোনো শিশুর শ্বাসকষ্ট হতে পারে। বাড়িতে রেখেই চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব তাদের। আর শিশুরা যেহেতু এখন বাইরে যাচ্ছে না, তাই বাইরের কেউ বা মা–বাবার করোনা না হলে, তাদের সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা কম। তাই বাবা–মায়েরা যাঁরা বাইরে বের হন, তাঁরা শিশুর কাছে আসার আগে অবশ্যই জীবাণুমুক্ত হয়ে নেবেন।