উপকারী ইসবগুল

ইসবগুল
ছবি: উইকিপিডিয়া

ইসবগুল উপমহাদেশের সবাই চেনে। এর নানাবিধ উপকারিতা সম্পর্কেও আমরা ওয়াকিবহাল। নামের সঙ্গে ‘গুল’ আছে বলে অনেকে ভাবি, হয়তো কোনো ক্ষুদ্র ফুলের সূক্ষ্ম পাপড়ি হবে। কিন্তু এর সম্পর্ক ফুলের সঙ্গে নয়, বীজের সঙ্গে। সঠিকভাবে বলতে গেলে বীজের খোসার সঙ্গে, যাকে আমরা ইসবগুলের ভুসি বলে জানি। বিদেশি বাজারে এটা সিলিয়াম হাস্ক (Psyllium husk) হিসেবে পরিচিত। গ্রিক ‘সিলা’ (psylla) অর্থ একধরনের মাছি, ডানাহীন ফ্লি—মাছি। ইসবগুলের বীজ দেখতে আকারে অবয়বে অনেকটা ফ্লি—মাছির মতো বলে ইংরেজিতে এই নাম।

ইসবগুল গাছ (Plantago ovata)
ছবি সূত্র: দি ওয়ার্ল্ড‌ বোটানিক্যাল অ্যাসোসিয়েটস্

ইসবগুল শব্দটা ফারসি ‘ইসপা-গোল’ থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘ঘোড়ার কান’। খুব ছোট হলেও খোসাগুলো শত শত গুণ বড় করে দেখলে ঘোড়ার কানের মতো মনে হতে পারে। যাহোক, কল্পনাকে জলাঞ্জলি দিয়ে, যোগ–বিয়োগ করে আমরা একে আত্তীকরণ করেছি বাংলায়, যা উচ্চারণগতভাবে ‘ইশবগুল’ এবং বানানে ‘ইসবগুল’।

ইসবগুলের ভুসি ও বীজের প্রধান ব্যবহার কোষ্ঠকাঠিন্যে। আমরা সাধারণত এর ভুসিই বেশি ব্যবহার করি। কারণ, এটি সহজলভ্য। শরীরের নানা সমস্যায়, খাদ্যাভ্যাসের দরুন, ওষুধ খাওয়া, দীর্ঘ যাত্রায় বহুক্ষণ এক স্থানে অনড় বসে থাকা, এমনকি গর্ভবতী অবস্থায়ও কারও কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দিতে পারে। অন্য ওষুধের সঙ্গে ইসবগুল পথ্য হিসেবেও খাওয়া যেতে পারে, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই বলে।

ভেজানো ইসবগুল
ছবি: প্যালিওস্তা

ইসবগুল একধরনের ডায়েটারি ফাইবার, যার কিছু পানিতে দ্রবীভূত হয়, কিছু হয় না। অন্ত্রের ভেতরে থাকাকালীন ইসবগুলের ভুসি প্রচুর পরিমাণ পানি শোষণ করে, কোনো কিছুর সঙ্গে বিক্রিয়া করে বিষ তৈরি করে না এবং অন্ত্রের দেয়াল পিচ্ছিল করে দেয়। যেহেতু এটা কার্যকারিতার জন্য অন্ত্র থেকে পানি শোষণ করে, তাই দুই চা-চামচ ভুসি, পানি বা দুধে গুলিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই খেয়ে ফেলা ভালো। দীর্ঘক্ষণ ভিজিয়ে রাখলে এটা বাইরে থেকেই পানি শোষণ করে নেবে, অতএব কার্যকারিতাও কমে যাবে।

কোষ্ঠকাঠিন্যের বিপরীতে ইসবগুল কিন্তু ডায়রিয়া প্রতিষেধক হিসেবেও কাজ করে, বিশেষত দইয়ের সঙ্গে খেলে। উল্লিখিত দুটি রোগ ছাড়াও আয়ুর্বেদ একে অ্যাসিডিটি, অর্শ, মূত্র প্রদাহ, মূত্রস্বল্পতা এবং দীর্ঘ মেয়াদে শ্বাসজাতীয় রোগেও ব্যবহার করে থাকে। জার্মান হেলথ অথরিটি রক্তে কোলেস্টেরল কমানোর জন্য একে ১৯৯০ সালে ব্যবহারের জন্য অনুমোদন করেছে। ইদানীং কোলন ক্যানসার ও হার্টের অসুখেও এর ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। খাদ্যের প্রতি ‘ক্রেভিং’ বন্ধ করে বলে অনেকে একে স্লিম হওয়ার জন্য ব্যবহার করে থাকেন।

ইসবগুলের আদি বাসভূমি ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে। ক্রমে এর বিস্তৃতি ঘটেছে স্পেন, উত্তর আফ্রিকা, পাকিস্তানের সিন্ধু এলাকা, চীন, রাশিয়া ও ভারতে। ‘প্ল্যান্ট্যাগো’ জেনাসের প্রায় ২০০ প্রজাতি আছে, যার ১০টি পাওয়া যায় ভারতে। অনুমান করা হয়, ভারতে ইসবগুল প্রবেশ করেছে ষোড়শ শতকে, মোগল আমলে। পৃথিবীতে বাণিজ্যিকভাবে যে কটি প্রজাতি চাষের জন্য ব্যবহার করা হয়, এর মধ্যে আছে ফ্রান্সের কালো বীজ প্ল্যান্ট্যাগো ইন্ডিকা (Plantago indica), স্পেনীয় প্ল্যান্ট্যাগো সিলিয়াম (Plantago psyllium) ও ভারতীয় সাদাটে বীজ প্ল্যান্ট্যাগো ওভাটা (Plantago ovata)।

ইসবগুল (Plantago ovata) গাছ দেড় থেকে দুই ফুট লম্বা হয়। ফল দুই কোষবিশিষ্ট, সাত-আট মিলিমিটার লম্বা, যার ভেতরে তিন মিলিমিটার লম্বা বীজ থাকে। বীজ দেখতে নৌকার মতো, যার খোসায় পিচ্ছিল মিউসিলেজ বা শ্লেষ্মা থাকে। এটা একধরনের রবিশস্য, যাকে আমরা ‘চৈতালি’ বলি। কারণ, হেমন্তে বীজ বপন করে চৈত্র মাসে ফসল তোলা হয়, যেমনটা করা হয় মুগ-মসুরের বেলায়। উপমহাদেশে ইসবগুলের চাষ সবচেয়ে বেশি হয় ভারতের গুজরাট অঞ্চলে। অন্যান্য অঞ্চলের মধ্যে আছে রাজস্থান, পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও উত্তর প্রদেশ। গুজরাট থেকে আমেরিকা ও ইউরোপে ইসবগুল রপ্তানি হয়।

ইসপগুলের বীজ
ছবি: কালচারাল হেলথ সলিউশনস

বিস্তৃতভাবে ধরলে অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত ইসবগুলের চাষ হতে পারে যখন বৃষ্টি থাকে না, তাপমাত্রা থাকে ১৫ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যে। আর্দ্র পরিবেশ, মেঘমেদুর আকাশ আর রাতের বেলা তাপমাত্রা বেশি হলে ফলন খুব কমে যায় ফসলের। আর পুষ্ট বীজ তোলার মৌসুমে বৃষ্টি হলে রক্ষা থাকে না, ক্ষতির পরিমাণ দেখে ইসবগুল-নির্ভর চাষিদের পরিবারে হাহাকার নেমে আসে। ইসবগুলের বীজ তিন মাস পর্যন্ত সুপ্ত অবস্থায় থাকে, এ সময়ে ঠান্ডা বা গরম পানি দিয়ে স্ক্যারিফিকেশন বা ঘষামাজা করেও বীজ থেকে চারা গজানো যায় না। কিন্তু মৌসুমে, উপযুক্ত তাপমাত্রায় ৯০ শতাংশ বীজ থেকে চারা গজিয়ে থাকে। বীজের এই প্রকৃতিগত সুপ্তাবস্থার কারণে এখন পর্যন্ত বীজ থেকে বছরে বহুবার (Multivoltine) ফসল তৈরি করা সম্ভব হয়নি।

বীজ থেকে খোসা আলাদা করা একধরনের সূক্ষ্ম কাজ। এর জন্য সাধারণ জাঁতাকল ছাড়াও নানা রকম আধুনিক যান্ত্রিক পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে, যেমন ফ্লুইড এনার্জি মিল, বল মিল, ভাইব্রেটিং মিল এবং পিন মিল। বহুল ব্যবহৃত পিন মিলের দুটো চাকাতেই চক্রাকারে অজস্র পিন লাগানো থাকে। চাকাগুলো বিপরীত গতিতে ঘোরার সময় দুই পাশের পিনে ঠোকা খেয়ে ইসবগুলের বীজ থেকে খোসা আলগা হয়ে যায়। ফ্লুইড এনার্জি মিলের প্রকোষ্ঠে অতিবেগে স্টিম বা বায়ু চালিত করার ফলে বীজে বীজে ঠোকাঠুকি লেগে খোসা আলাদা হয়ে যায়। বল মিলে বীজের মিশ্রণের সঙ্গে পাথর বা ধাতব বল মিশিয়ে ঘোরানো হয়, ভাইব্রেটিং মিলে কম্পনের মাধ্যমে খোসা আলাদা করা হয়। যেভাবেই খোসা আলাদা করা হোক, সব পদ্ধতিরই প্রধান লক্ষ্য থাকে খোসা উৎপাদন করতে গিয়ে যেন বীজ ভেঙে টুকরো না হয়ে যায়।

ইসপগুলের খোসা ছাড়ানোর যন্ত্র
ছবি: পেরি প্রসেস ইকুইপমেন্ট-২

যাহোক, সব কারখানাতেই কিছু না কিছু বীজ ভেঙে যায়, যেগুলো চালুনি দিয়ে আলাদা করা হয়। আবার খড়কুটো ধুলাবালু থেকে মুক্ত করার জন্য যেভাবে কুলো দিয়ে ধান ওড়ানো হয়, সেভাবে খোসাও ওড়ানো হয়, সাবধানে হালকা বাতাসে।

পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন এই উদ্ভিজ্জাত দ্রব্যের ব্যবহার নানা দেশে প্রাচীনকালে ছিল, ছিল ভারতীয় আয়ুর্বেদেও; এখন যা আবার নতুন করে শুরু হয়েছে। মানুষ ক্রমে প্রাকৃতিক ওষুধের গুণাগুণ সম্পর্কে অবহিত হয়ে একে অধিকতর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করছে। পৃথিবীর নানা অঞ্চলে যেসব ওষুধ আগে ভেষজ ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, তার ২৫ শতাংশ এখন বর্তমান প্রেসক্রিপশনে ব্যবহার করা হচ্ছে এবং দিন দিন এর ব্যবহার বেড়েই চলেছে।

লেখক: কিউরেটর (টেক), সায়েন্স ওয়েসিস জাদুঘর, রিয়াদ, সৌদি আরব