আত্মহত্যা কোনো সমস্যার সমাধান নয়
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বছরে সাত লাখের বেশি মানুষ বিশ্বজুড়ে আত্মহত্যা করে। প্রতি ৪০ সেকেন্ডে ১ জন! মানসিক বিপর্যয়ের কারণেই বেশির ভাগ আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে থাকে। বিষণ্নতা, ব্যক্তিত্বের সমস্যা, সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার ডিজঅর্ডার, মাদকাসক্তি ইত্যাদি মানসিক রোগের যথাযথ চিকিৎসা না করলে এবং সম্পর্কজনিত জটিলতা, ব্যর্থতা ইত্যাদি মেনে নিতে না পেরে কেউ কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। পরিবারে যদি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে থাকে, তবে পরিবারের অন্য সদস্যদেরও আত্মহত্যার ঝুঁকি থেকে যায়। মাদক গ্রহণ, যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়া, বয়ঃসন্ধিকালে দেহ ও মনের পরিবর্তনগুলোর সঙ্গে মেনে নিতে সমস্যা, পারিবারিক সমস্যা ইত্যাদির কারণেও কেউ কেউ আত্মহত্যা করে থাকেন। তবে মনে রাখতে হবে, আত্মহত্যা কোনো সমস্যার সমাধান নয়।
প্রতিদিনের জীবনে সবকিছু আপনার অনুকূলে থাকবে না, কখনো কখনো বিরূপ পরিস্থিতি কিংবা ব্যর্থতার মুখে পড়তে পারেন। তখন কিন্তু আত্মহত্যাকে বেছে নেওয়া যাবে না। বরং প্রতিকূলতাকে মোকাবিলা করার চেষ্টা করতে হবে, ব্যর্থতাকে অতিক্রম করার চেষ্টা করতে হবে। নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, ‘আমার সফলতার ভিত্তিতে আমাকে বিচার করো না, আমার বিচার করো আমার ব্যর্থতা এবং ব্যর্থতার পর ঘুরে দাঁড়ানোর ভিত্তিতে।’ তাই কখনোই নিজেকে চিরতরে ব্যর্থ মনে করা চলবে না। নিজের যোগ্যতা, দক্ষতা আর বুদ্ধির সঙ্গে আবেগের যথাযথ সংমিশ্রণ ঘটিয়ে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। আমরা যদি সব সময় ব্যর্থতাকে আঁকড়ে ধরে থাকি, তবে সফলতা প্রবেশ করতে পারে না। সফলতাকে জায়গা করে দিতে ব্যর্থতার চিন্তা মন থেকে সরাতেই হবে, দূর করতে হবে আত্মহত্যার চিন্তা। বাড়াতে হবে সামাজিক দক্ষতা। বন্ধুবান্ধব বাড়াতে হবে।
সামাজিকভাবে দক্ষ হলে মনের ওপর চাপ কম পড়ে, মন সুস্থ থাকে। তখন মৃত্যুচিন্তা কাছে ঘেঁষতে পারে না, মনে হয়, এই তো জীবন কত সুন্দর। শিশুদের বিকাশের সময় তাদের এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে তারা সফলতার মতো ব্যর্থতাকে মেনে নিতে পারে। জীবনে সবকিছুর ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই। যেগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই, সেগুলো নিয়ে ভাবনা না করে যে বিষয়ের ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, সেগুলোর দিকে মনোযোগ বাড়াতে হবে।
আত্মহত্যা একটি প্রতিরোধযোগ্য বিষয়। সঠিক সময়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারলে অবশ্যই আত্মহত্যা ঠেকানো যায়। যাদের মধ্যে আত্মহত্যার চিন্তা আসতে থাকে, তাদের আচরণে সেটা নানাভাবে প্রকাশ পায়। যেমন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মৃত্যু আর আত্মহত্যা নিয়ে নিজের ইচ্ছার কথা প্রকাশ করা, নিজের ক্ষতি করা, হাত–পা কাটা, মন মরা হয়ে থাকা, সব কাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা, নিজেকে গুটিয়ে রাখা, নিজের পছন্দের জিনিসগুলো ভাইবোন বা বন্ধুদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে থাকা, খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দেওয়া, ঘুমের সমস্যা দেখা দেওয়া, কোনো কাজে মনোযোগ দিতে না পারা। এসব লক্ষণ দেখা দিলে তার প্রতি মনোযোগী হতে হবে। তার মনের যত্ন ঠিকমতো হচ্ছে কি না, খোঁজখবর নিতে হবে আর মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
গণমাধ্যম আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকেও হতে হবে সংবেদনশীল ও দায়িত্বশীল। আত্মহত্যার সংবাদ পরিবেশনের সময় গণমাধ্যমগুলোকে সব সময় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্দেশিত নিয়মগুলো মেনে চলতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ সাইটগুলোর ব্যবহারকারীদেরও সতর্কতার সঙ্গে আত্মহত্যার বিষয় নিয়ে মন্তব্য ও ছবি পোস্ট করতে হবে। মিডিয়াতে কোনো আত্মহত্যার ঘটনাকে খুব মহৎ করে দেখানোর চেষ্টা করা যাবে না। এমন কোনো শিরোনাম দেওয়া যাবে না, যাতে আত্মহত্যার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিরা উৎসাহিত হয়ে ভাবেন, ‘আত্মহত্যা সব মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তির সবচেয়ে বড় উপায়।’
আত্মহত্যা প্রতিরোধে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করা প্রয়োজন। পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বন্ধু-স্বজন এবং প্রচারমাধ্যমের সংবেদনশীল ভূমিকা আত্মহত্যা প্রতিরোধে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।