কিছু মানুষের শরীরে কেন কখনোই ঘামের দুর্গন্ধ হয় না

আমরা অনেকে বয়ঃসন্ধিকাল থেকেই ডিওডোরেন্ট ব্যবহার করছি। কারণ, বয়ঃসন্ধিকালে মানুষের শরীরে হরমোনজনিত বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটে। ফলে শরীরে প্রচুর ঘাম হয়। ঘাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং শরীরের দুর্গন্ধ দূর করতে ডিওডোরেন্টকেই অনেকে একমাত্র সমাধান বলে মনে করে। তবে কিছু মানুষ আছেন, যাঁদের ঘামের দুর্গন্ধ নিয়ে কোনো চিন্তাই করতে হয় না। এর পেছনে কয়েকটি কারণ আছে। মানুষের শরীরে কেন দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয় কিংবা হয় না, কোন কোন বিষয় আমাদের শরীরের স্বাভাবিক গন্ধের ওপর প্রভাব ফেলে, এসব ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা কী বলেন?

হাঁটতে যান, দুশ্চিন্তা তো বিদায় নিবেই, সঙ্গে মনও থাকবে সতেজছবি : প্রথম আলো

আমাদের শরীরে দুর্গন্ধ কেন হয়

ঘামের নিজস্ব কোনো কটু গন্ধ নেই। ঘামের বেশির ভাগই পানি। সঙ্গে থাকে সোডিয়াম ও ক্লোরাইডের মতো কিছু উপাদান। তবে ঘাম কোন ধরনের গ্রন্থি থেকে উৎপন্ন হচ্ছে, তার ওপর আমাদের শরীরে দুর্গন্ধের মাত্রা নির্ভর করে। দুই ধরনের ঘর্মগ্রন্থি শরীরে দুর্গন্ধ সৃষ্টির জন্য দায়ী—এক্রিন ও অ্যাপোক্রিন। এক্রিন গ্রন্থিগুলো পানির মতো এবং গন্ধহীন ঘাম সৃষ্টি করে। এ ধরনের ঘাম শরীরকে ঠান্ডা রাখে। এমন ঘাম সাধারণত গ্রীষ্মকালে আমাদের শরীরে হয় এবং শরীরেই শুকিয়ে যায়।

অন্য দিকে আমাদের শরীরের অ্যাপোক্রিন গ্রন্থিগুলোর কারণে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। চর্মরোগ–বিশেষজ্ঞদের মতে, শরীরে যেসব স্থানে চুল থাকে, যেমন মাথা, বগল ও কুচকিতে অ্যাপোক্রিন গ্রন্থির পরিমাণ বেশি। এসব গ্রন্থি থেকে উৎপন্ন ঘাম তুলনামূলক ঘন হয়।

এক্রিন গ্রন্থিগুলো থেকে উৎপন্ন ঘামে শুরুতে গন্ধ থাকে না। কিন্তু ত্বকের ব্যাকটেরিয়ার সংস্পর্শে আসার পর ঘামের প্রোটিন ও ফ্যাটি অ্যাসিডগুলো সংশ্লেষণের ফলে দুর্গন্ধের সৃষ্টি হয়। আমরা যখন ক্লান্ত বা অবসন্ন হই, তখন আমাদের অ্যাপ্রোক্রিন গ্রন্থিগুলো থেকে ঘাম উৎপন্ন হয়। এর অর্থ হলো, যখন আমাদের চাপ বেশি থাকে, তখন আমাদের শরীরে ঘামের দুর্গন্ধ হওয়ার আশঙ্কা বেশি।

এ ছাড়া ট্রাইমেথালামেনুরিয়া নামের একটি রোগের কারণে মানুষের ঘাম, নিশ্বাস ও মূত্র থেকে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়। কিডনি রোগ, ডায়াবেটিস, এমনকি লিভার ফেইলিওরের কারণেও শরীরে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়।

আরও পড়ুন

কিছু মানুষের শরীরে কেন দুর্গন্ধ হয় না

কিছু কারণে কারও কারও শরীরে খুব একটা দুর্গন্ধ হয় না। চর্মরোগ–বিশেষজ্ঞদের মতে, পূর্ব এশীয়দের মধ্যে একটি জেনেটিক ভ্যারিয়েশন এবিসিসি১১ নামের একটি প্রোটিনের সৃষ্টিকে প্রভাবিত করে। এই জিন ভ্যারিয়েশনের কারণে একটি নির্দিষ্টসংখ্যক জনগোষ্ঠীর শরীরে তুলনামূলক কম দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়। কারণ, তাঁদের ঘামে প্রোটিনের পরিমাণ কম থাকে। কম প্রোটিন ব্যাকটেরিয়ার সংস্পর্শে এসে সংশ্লেষিত হয়ে গন্ধ সৃষ্টিকারী উপাদান কম তৈরি হয়।

২০১০ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, পূর্ব এশীয়দের মধ্যে ৮৫-৯৫ শতাংশ এবং আফ্রিকান ও ইউরোপীয়দের মধ্যে ৩ শতাংশ মানুষ এই জিন বহন করে। মজার ব্যাপার হলো, অপর এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রয়োজন না থাকলেও এবিসিসি১১ জিন ভ্যারিয়েশন বহনকারী ব্যক্তিরা ডিওডোরেন্ট ব্যবহার করেন।

খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে ঘামের কি সম্পর্ক আছে

হ্যাঁ, জিনগত বিষয় ছাড়াও খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে শরীরের দুর্গন্ধের সম্পর্ক আছে। রেড মিট, অ্যালকোহল, ক্রুসিফেরাস সবজি (যেমন বাঁধাকপি), রসুন, পেঁয়াজের মতো খাবার শরীরে দুর্গন্ধ সৃষ্টির জন্য দায়ী। তাই এসব খাবার যাঁরা বেশি খান না, তাঁরা অন্যদের তুলনায় দুর্গন্ধমুক্ত থাকেন। এ ছাড়া কিছু মসলা, যেমন কারিপাতা, জিরা, মেথিতে এমন কিছু যৌগ আছে, যেসব শরীরে অনেক বেশি সময় ধরে অবস্থান করে। এসবের কারণেও দুর্গন্ধ সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

আরও পড়ুন

আমরা কি নিজেদের ঘামের দুর্গন্ধ টের পাই

চর্মরোগ–বিশেষজ্ঞদের মতে, মানুষ নিজের ঘামের দুর্গন্ধ নিজে টের না-ও পেতে পারে। কারণ, আমাদের মস্তিষ্ক আমাদের নিজেদের শরীরের গন্ধের মতো ধ্রুবক (যেসব অপরিবর্তিত থাকে) উদ্দীপনাগুলোকে ছেঁকে ফেলে দেয়। এতে ধীরে ধীরে আমাদের আশপাশের পরিবেশের অপরিচিত গন্ধের প্রতি আমাদের মনোযোগ বৃদ্ধি পায়। ফলে মনে হতে থাকে, আমাদের শরীরে কোনো দুর্গন্ধ হয় না। কিন্তু বাস্তবে আমাদের আশপাশের মানুষেরা আমাদের শরীরের দুর্গন্ধ ঠিকই টের পায়। কাজেই আপনার বন্ধুরা যদি বলে, আপনার শরীরে ঘামের দুর্গন্ধ, তাহলে কথাটা সত্যি হওয়ার আশঙ্কাই বেশি।

শরীরের দুর্গন্ধ দূর করার কিছু উপায়

  • নিয়মিত গোসল করুন। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন।

  • ঢিলেঢালা, বাতাস চলাচল করতে পারে—এমন পোশাক পরুন। ঘাম যাতে শরীরে আটকে না থাকে।

  • প্রচুর পানি খান। পানি ঘামকে পাতলা করে দেয়।

  • দুর্গন্ধ সৃষ্টিকারী খাবার (পেঁয়াজ, রসুন ইত্যাদি) যতটা সম্ভব কম খান।

  • ডিওডোরেন্ট ও অ্যান্টিপারসপিরেন্ট ব্যবহার করুন। অ্যান্টিপারসপিরেন্ট ঘাম তৈরি হতে দেয় না।

  • বগল পরিষ্কার রাখতে বেনজাইল পারঅক্সাইড বডিওয়াশ ব্যবহার করুন। এটি বগলের দুর্গন্ধ দূর করতে পারে।

  • দুশ্চিন্তা ও অবসাদের কারণে অ্যাপোক্রিন গ্রন্থি থেকে বেশি পরিমাণে ঘাম নির্গত হয়। এই ঘামে দুর্গন্ধের মাত্রা স্বাভাবিক সময়ের ঘামের চেয়ে বেশি। তাই যতটা সম্ভব দুশ্চিন্তা ও অবসাদমুক্ত থাকার চেষ্টা করুন। চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতিতে ধ্যানের মাধ্যমে চাপমুক্ত থাকতে পারলে শরীরে দুর্গন্ধ সৃষ্টির আশঙ্কা কমে।

সূত্র: ইয়াহু লাইফ

আরও পড়ুন