মেয়েকে মাসিক সম্পর্কে কীভাবে জানাবেন
কারও আটে, তো কারও ১৩–তে। এ দেশের মেয়েদের প্রথম মাসিক হওয়ার স্বাভাবিক বয়স ১২ বছর। যেসব শিশুর কম বয়সেই মাসিক শুরু হয়, তাদের মানসিকভাবে সমর্থন দেওয়া ভীষণ জরুরি।
প্রথম মাসিক প্রত্যেক মেয়ের জীবনেই গুরুত্বপূর্ণ একটা ঘটনা। স্বাভাবিক এ বিষয় সম্পর্কে আগে থেকে না জানা থাকার ফলে অনেক মেয়েকেই ভয়, সংকোচ, দ্বিধা ও লজ্জার এক মিশ্র অনুভূতির ভেতর দিয়ে যেতে হয়। অনেক মা নিজেই নিজের ছোট্ট মেয়েকে মাসিকের কথা জানাতে অস্বস্তি বোধ করেন। কবে, কখন, কীভাবে বয়ঃসন্ধিবিষয়ক আলাপ করতে হবে, বুঝে উঠতে পারেন না। শারীরিক সুস্থতা ও মানসিক স্থিতিশীলতার জন্যই বিষয়টি সম্পর্কে তাকে স্বচ্ছ ধারণা দেওয়া জরুরি।
কোন বয়সে কার মাসিক শুরু হবে, এটা অবশ্য আগে থেকে ধারণা করা যায় না। কারও আটে, তো কারও ১৩–তে। এ দেশের মেয়েদের প্রথম মাসিক হওয়ার স্বাভাবিক বয়স ১২ বছর। ১২ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগে কারও মাসিক শুরু হলে কিছু হরমোনের পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া প্রয়োজন। তবে যে বয়সেই মাসিক শুরু হোক না কেন, সে যাতে কোনো মানসিক যাতনার ভেতর দিয়ে না যায়, সেই বিষয়ে যত্নশীল হতে হবে। এমনটাই বলছিলেন হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ তানজিনা হোসেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের শিশু বিভাগের কনসালট্যান্ট তাসনুভা খান বলছিলেন, কম বয়সে মাসিক শুরু হওয়ার জন্য অনেক কারণই দায়ী হতে পারে। এই যেমন অতিরিক্ত ওজন কিংবা অতিরিক্ত মানসিক চাপ। পরিবেশ ও জিনগত কিছু কারণও দায়ী। শৈশবে দৌড়ঝাঁপ ও ছোটাছুটি করার স্বাভাবিক প্রবণতাকে উৎসাহ দেওয়া উচিত। ডিজিটাল ডিভাইস নির্ভর না হয়ে শিশুর বিনোদন এমন হওয়া উচিত, যাতে সে উচ্ছলতায় হুটোপুটি করেই সময় কাটায়। ফাস্ট ফুডও এড়িয়ে চলা উচিত, যাতে সব মিলিয়ে শিশুর ওজন থাকে নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে। আর যেসব শিশুর কম বয়সেই মাসিক শুরু হয়, তাদের মানসিকভাবে সমর্থন জোগানো ভীষণ জরুরি। খুব ছোট শিশুকে অনেক কথাই বুঝিয়ে বলা সম্ভব নয়। তবে এ বয়সে মাসিক হয়ে গেলে বুঝিয়ে বলুন, এটা স্বাভাবিক। এটা সব মেয়েরই হয়। বড় হওয়ার পথে এটা খুব সাধারণ একটা ধাপ। এটা কোনো রোগ নয়।
কখন, কীভাবে বলা যায়
বাংলাদেশ শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক সিনিয়র চাইল্ড সাইকোলজিস্ট এবং আন্তর্জাতিক অটিজম প্রশিক্ষক নার্সিস রহমান জানান, আট বছর বয়সেই মেয়েকে মাসিক সম্পর্কে জানানো উচিত। খুব সহজ, সাবলীল ভঙ্গিতে আলাপ করতে হবে সংবেদনশীল এ বিষয় নিয়ে। একজন মা এভাবে বলতে পারেন, ‘এই যে আমি তোমার মা, আমি কিন্তু এক দিনে তোমার মা হইনি। ছোট্ট থেকে ধীরে ধীরে বড় হয়েছি। তুমি নিজেও আগে ছোটটি ছিলে। এখন বড় হচ্ছ। বড় হওয়ার একটা ধাপে পা রাখতে যাচ্ছ তুমি। সবাই এভাবেই বড় হয়।’
আপনি বোঝানোর আগে তার মাসিক শুরু হয়ে গেলেও একইভাবে বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করুন, তার বয়স ও মানসিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে তার সঙ্গে আলাপ করুন বিষয়টি নিয়ে। এই যেমন আট বছর পেরোনো শিশুকে আরও বলতে পারেন, ‘তুমি যেমন লম্বা হচ্ছ, তোমার চুল যেমন বড় হচ্ছে, তেমনি তোমার শরীরের ভেতরেও কিছু বদল হচ্ছে, যা তুমি দেখতে পাচ্ছ না। আস্তে আস্তে এমন কিছু পরিবর্তন আসবে, যা তুমি দেখতে পাবে। শরীরের কিছু জায়গায় লোম গজাবে।’ মাসিক শুরু না হয়ে থাকলে এভাবে বলতে পারেন, ‘যেখানটা দিয়ে তুমি হিসু করো, সেখান দিয়ে হঠাৎ অল্প সময়ের জন্য রক্তও আসবে।’
মাসিকসংক্রান্ত কথা বলার সময় অনেক শিশু ভয় পেয়ে যেতে পারে। তাই তাকে আশ্বস্ত করতে হবে। বোঝান, আপনি নিজেও এ ধাপ পেরিয়ে এসেছেন। এ ধাপ না পেরোলে মা তাকে পৃথিবীতে আনতে পারতেন না। এসব কিছু না ঘটলে সে বড় হবে না। এই হলো জীবনের এক নতুন অভিজ্ঞতা। বোন, বান্ধবী—সবারই এ অভিজ্ঞতা হয়েছে বা হবে।
প্রস্তুত থাকুক শিশু
মাসিক হওয়ার আগে মাসিক সম্পর্কে ধারণা তো দেবেনই, সেই সময়ের করণীয় সম্পর্কেও খানিকটা বলে রাখতে পারেন।
স্যানিটারি ন্যাপকিনের প্যাকেট খুলে দেখাতে পারেন। এর ব্যবহারবিধিও সহজভাবে বুঝিয়ে বলতে পারেন। একটা পুতুলের সাহায্যে দেখিয়েও দিতে পারেন।
মাসিকের সময়কার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কেও বলুন।
স্কুলে কিংবা বেড়াতে গেলে যে ব্যাগ নেওয়া হয়, সেটির এক কোণে একটি স্যানিটারি ন্যাপকিন দিয়ে রাখা ভালো।
স্কুলে বা বন্ধুর বাসায় প্রথম মাসিক হলে সঙ্গে সঙ্গে স্কুলের নারী শিক্ষক কিংবা বন্ধুর মায়ের সহায়তায় নিজের মাকে জানাতে হবে, সেটিও বলে রাখুন।
প্রথম অভিজ্ঞতা এবং তারপর
আগে থেকে জানা থাকলেও প্রথম অভিজ্ঞতা বেশ অস্বস্তিকর হয়ে দাঁড়াতে পারে। এ সময়ে মায়ের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মেয়েকে সাহস জোগান। ছোটখাটো উপহারও দিতে পারেন। প্রতিবার মাসিকের সময় মেয়ের বাড়তি যত্ন নিন।
পর্যাপ্ত পানি খেতে উৎসাহ দিন। পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা করুন। তার মনের মতো খাবার তৈরি করে দিন।
এ সময়ে তার মন খারাপ লাগতে পারে, সে খিটখিটে হয়ে যেতে পারে। আপনি তাকে জড়িয়ে ধরুন, ভালোবাসার স্পর্শ দিন। ভরসার জায়গা হয়ে উঠুন। খেলাধুলাতেও উৎসাহ দিন। তলপেটে ব্যথা হলে হালকা গরম সেঁক দিয়ে দিন।
আগে থেকে জানা না থাকলে শিশু হঠাৎ রক্ত দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়তে পারে। ভাবতে পারে, সে মারা যাচ্ছে। কেউ আবার ভাবে, সে বড় কোনো অন্যায় করেছে বলে এমনটা হচ্ছে। ধর্মীয় রীতিনীতিতে কিছু বিধিনিষেধ থাকায় কেউ আবার মাসিক হওয়াটাকে ভীষণ নোংরা বিষয় মনে করতে পারে। আপনার কাছ থেকে সঠিক জ্ঞান পেলে সে এসবের কিছুই ভাববে না।