ডেঙ্গুর কোন গ্রুপে কেমন চিকিৎসা, জটিলতা বেশি কাদের

ছবি: কবির হোসেন

ডেঙ্গু একধরনের ভাইরাসজনিত জ্বর। ডেঙ্গু উপসর্গের মধ্যে খুব সাধারণ কিছু উপসর্গ হচ্ছে—তীব্র জ্বর, মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা, অস্থিসন্ধিতে ব্যথা, বমি, বমিভাব, পাতলা পায়খানা, র‍্যাশ, চামড়া ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে রক্তপাত, দুর্বলতা ইত্যাদি। কিছু ডেঙ্গু আবার উপসর্গহীন। চিকিৎসার সুবিধার জন্য উপসর্গ ও অন্য কিছু মানদণ্ডের ওপর ভিত্তি করে ডেঙ্গু রোগীদের তিন ভাগে ভাগ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা—এ, বি ও সি। এ গ্রুপের রোগীরা সতর্কতা চিহ্নবিহীন, এসব ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা বাসায় হবে। সতর্কতা চিহ্নসহ ডেঙ্গু শনাক্ত হওয়া রোগীরা বি পড়বে, যাদের চিকিৎসা হবে হাসপাতালে। আর সি গ্রুপে ফেলা হয় সেই সব রোগীকে, যারা গুরুতর ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত। আইসিইউ সাপোর্ট আছে এমন বিশেষায়িত হাসপাতালে জরুরিভিত্তিতে তাদের চিকিৎসা করাতে হবে।

এবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত এই তিন দলের বিষয়ে আরও বিশদ জেনে নিন।

গ্রুপ এ: সতর্কতা চিহ্নহীন ডেঙ্গু

গ্রুপ এ–তে থাকা ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা বাড়িতেই সম্ভব। মডেল: রিয়া
ছবি: কবির হোসেন

জ্বর, মাথাব্যথা, ‌র‍্যাশ ইত্যাদি থাকলেও কোনো রকম বিপদের চিহ্ন বা সতর্কতামূলক চিহ্ন না থাকায় এই গ্রুপের রোগীদের বাসায় রাখা যাবে। এমন রোগীর ক্ষেত্রে চিকিৎসা অনেকটা এ রকম—

  • পরিপূর্ণ বিশ্রাম।

  • পরিমিত পানি ও তরল পান। এর মধ্যে থাকতে পারে পানি, স্যুপ, দুধ, জুস, স্যালাইনের পানি ইত্যাদি। স্বাভাবিক পূর্ণ বয়স্ক মানুষের জন্য এই তরলের পরিমাণ হবে ২ দশমিক ৫ লিটার বা ৮-১০ গ্লাস।

  • জ্বর ও ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল খেতে পারবে। তবে রোগীর বয়স ও ওজন অনুযায়ী চিকিৎসক সেটির ডোজ ঠিক করে দেবেন।

  • কোনো ধরনের ব্যথানাশক ওষুধ (এনএসএআইডি) খাওয়া যাবে না।

  • যদি অবস্থা খারাপ হতে থাকে, চার থেকে ছয় ঘণ্টা কোনো প্রস্রাব না হয় অথবা কোনো সতর্কতা চিহ্ন চলে আসে, তাহলে রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে।

গ্রুপ বি: সতর্কতা চিহ্নযুক্ত ডেঙ্গু

ডেঙ্গু রোগীর প্রচণ্ড পেটব্যথা হলে ধরে নিতে হবে তিনি গ্রুপ বি–তে আছেন
ছবি: অধুনা

এই গ্রুপের মধ্যে আছে তারা, যাদের সাধারণ উপসর্গের সঙ্গে কিছু বিপদের চিহ্ন বা সতর্কতা চিহ্ন আছে। সেই সঙ্গে নির্দিষ্ট কিছু বয়স ও বিশেষ রোগাক্রান্ত রোগীরাও এই গ্রুপে পড়বে। এই গ্রুপের রোগীকে অবশ্যই হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে হবে। নির্দিষ্ট কিছু বয়স ও বিশেষ রোগাক্রান্ত রোগীর মধ্যে পড়বে শিশু, বৃদ্ধ, অন্তঃসত্ত্বা নারী, ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, হার্টের রোগী, কিডনি রোগী, দুর্বল রোগ প্রতিরোধক্ষমতাসম্পন্ন রোগী, রক্তরোগ থাকলে এবং স্টেরয়েড বা অন্য কোনো ইমিউনোসাপ্রেসেন্ট অথবা রক্ত পাতলা করার ওষুধ খেলে।

এই গ্রুপের রোগীর কিছু সতর্কতা চিহ্ন আছে। যেমন:

  • অনবরত বমি

  • প্রচণ্ড পেটব্যথা

  • অতিরিক্ত দুর্বলতা

  • অল্প রক্তপাত

  • বুকে বা পেটে পানি আসা

  • লিভার বড় হয়ে যাওয়া

  • রক্তের হেমাটোক্রিট বেড়ে যাওয়া বা দ্রুত প্লাটিলেট কমে যাওয়া।

এই গ্রুপের রোগীকে হাসপাতালে ভর্তির পর প্রয়োজন অনুযায়ী শিরায় স্যালাইন ও অন্যান্য চিকিৎসা দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে নিয়মিত রক্তের বিভিন্ন পরীক্ষা, রক্তচাপ, রক্তের সুগার, প্রস্রাবের পরিমাণ ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করা হয় ও রোগীর অবস্থা বুঝে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে রক্ত বা প্লাটিলেট দিতে হবে কি না, সেটি চিকিৎসকই ভালো বলতে পারবেন এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন।

আরও পড়ুন

গ্রুপ সি: গুরুতর ডেঙ্গু

ডেঙ্গু রোগীকে প্রচুর তরল খেতে বলা হয়
ছবি: কবির হোসেন

এই গ্রুপের মধ্যে পড়বে অতিরিক্ত রক্তপাতের রোগী, শকের রোগী (যাদের রক্তচাপ অনেক কম অথবা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, প্রস্রাব তৈরি হচ্ছে না, শরীর নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে), এক্সপান্ডেড ডেঙ্গু রোগী (ডেঙ্গু থেকে যাদের হার্ট, ফুসফুস, কিডনি ও মস্তিষ্ক আক্রান্ত হবে) ও রক্তের ইলেক্ট্রোলাইট ও অন্যান্য মেটাবলিক সমস্যা থাকলে।

এই গ্রুপে থাকা ডেঙ্গু রোগীর জটিলতা বেশি। জটিলতা দেখা দিলে এসব রোগী মস্তিষ্কে প্রদাহ হয়ে অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে, মায়োকার্ডাইটিস হয়ে বুকে ব্যথা বা হার্ট অ্যাটাকের মতো হতে পারে, ফুসফুসে পানি জমে রেসপিরেটরি ফেইলিউর বা কিডনি ফেইলিউর হতে পারে। এই গ্রুপের যেকোনো সময় কার্ডিয়াক মনিটরিং, ডায়ালাইসিস, কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যবস্থার প্রয়োজন হতে পারে। তাই এদের এমন হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে হবে, যেখানে আইসিইউসহ সব সুযোগ-সুবিধা আছে। এসব রোগী একদল চিকিৎসকের নিবিড় পর্যবেক্ষণে থাকবে। মনে রাখতে হবে, সব ধরনের চিকিৎসা দেওয়ার পরেও এসব রোগীর উল্লেখযোগ্য অংশ মারা যেতে পারে। দ্রুত সময়োপযোগী সিদ্ধান্তই পারে এসব রোগীর জীবন বাঁচাতে।