করোনার সু-অভ্যাসগুলো মেনে চললে এসব রোগবালাই থেকে রক্ষা পাবেন
অনেক ক্ষতির পাশাপাশি করোনা আমাদের অনেক সু-অভ্যাসও গড়ে দিয়ে গেছে। যেমন সঠিক নিয়মে মাস্ক পরা, সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, হাত জীবাণুমুক্ত করতে স্যানিটাইজার ব্যবহার, হাঁচি–কাশি দেওয়ার সময় রুমাল বা কনুই দিয়ে মুখ ঢেকে নেওয়া, সামাজিক দূরত্ব মানা, বাইরের অস্বাস্থ্যকর খাবার এড়িয়ে চলা ইত্যাদি।
গবেষণা বলছে, করোনার সময় এসব অভ্যাস রপ্ত করার কারণে একই সঙ্গে কমে গিয়েছিল নিউমোনিয়া, ফ্লু, ডায়রিয়ার মতো রোগ। করোনা এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে, তাই অভ্যাসগুলো মেনে চলার ক্ষেত্রে আগের সেই কড়াকড়িও এখন আর নেই। তবে অনেকেই এগুলো এখন নিয়মিত চর্চায় পরিণত করেছেন।
তার চেয়ে বড় কথা, করোনা পুরোপুরি চলে যায়নি। বিজ্ঞানীরা বলছেন, করোনা যাবেও না, বরং আর দশটা সংক্রামক রোগের মতোই পরিবেশে রয়ে যাবে; সঙ্গে মৌসুমি রোগ, যেমন ইনফ্লুয়েঞ্জা, নিউমোনিয়া, টাইফয়েড, ডেঙ্গু, ডায়রিয়া, কলেরা, চিকেন পক্স বা জলবসন্তের মতো সংক্রামক রোগগুলো তো আছেই। তাই সু-অভ্যাসগুলো সব সময় মেনে চললে করোনা ছাড়া আরও অনেক রোগবালাইকে আমরা দূরে রাখতে পারব। স্বাস্থ্য সুরক্ষার সাধারণ নিয়মকানুন কীভাবে আমাদের করোনাসহ সব ধরনের সংক্রামক রোগ থেকে সুরক্ষিত রাখে, চলুন, জানার চেষ্টা করি।
মাস্কের ব্যবহার
নাক-মুখ ঢেকে মাস্ক ব্যবহার করলে শ্বাসতন্ত্র ও ফুসফুস সুরক্ষিত থাকে। ফেস মাস্ক শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমে জীবাণুর সংক্রমণ প্রতিরোধ করে। ভাইরাসজনিত সাধারণ ফ্লু, ইনফ্লুয়েঞ্জা, হাম, মাম্পস, জলবসন্ত এবং ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াজনিত নিউমোনিয়া ও যক্ষ্মা ঠেকাতে মাস্ক খুব কার্যকর। শ্বাস নেওয়ার সময় যে বাতাস আমাদের ফুসফুসে প্রবেশ করে, তাতে আর্দ্রতা বাড়িয়ে তোলে মাস্ক। আর্দ্রতাযুক্ত শ্বাস শরীরে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে ভূমিকা রাখে। আর্দ্রতার পরিমাণ বেশি হলে শ্বাসতন্ত্রে জীবাণু সংক্রমণের বিস্তার বাধাপ্রাপ্ত হয়। আবার দূষিত পরিবেশের ধুলাবালুর আক্রমণ ঠেকিয়ে অ্যালার্জি এবং অ্যালার্জিজনিত অসুখ, যেমন হাঁপানি নিয়ন্ত্রণেও মাস্ক কার্যকর। নতুন নতুন গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, বায়ুদূষণ নানাবিধ রোগের কারণ। বায়ুদূষণ থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতেও ফেস মাস্ক ব্যবহার করা দরকার।
হাঁচি-কাশির আদবকেতা
হাঁচি-কাশি দেওয়ার সময় টিস্যু বা রুমাল, আর কিছু না পাওয়া গেলে কনুই ভাঁজ করে নাক-মুখ ঢাকতে হবে। হাঁচি-কাশির ছিটা বা থুতুকে বলে ড্রপলেট। অনেক সংক্রামক রোগ ড্রপলেটের মাধ্যমে একজন থেকে আরেকজনে ছড়ায়। এসব শিষ্টাচার অভ্যাসে পরিণত করতে সময় লাগে। কিন্তু গত দুই থেকে আড়াই বছরে করোনা মহামারিতে যাঁরা এই সু–অভ্যাসে অভ্যস্ত হয়েছেন, তাঁদের উচিত সব সময় তা মেনে চলা। শিশুরাও যেহেতু এতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল, তাই তাদের বারবার শেখান। একবার রপ্ত হয়ে গেলে সারা জীবনের জন্য আর ভুল করবে না। ভবিষ্যতে আরও নতুন ধরনের রোগবালাই থেকেও রক্ষা মিলবে।
হাত ধোয়ার অভ্যাস
হাত ধোয়া কেন জরুরি, করোনাকালে সবাই সেটা বুঝে গেছে। সঠিক নিয়মে হাত ধোয়ার অভ্যাস করতে হবে। হাত ধুতে গিয়ে তাড়াহুড়া করা যাবে না। দুই কনুই পর্যন্ত সাবান মাখিয়ে কমপক্ষে ২০ সেকেন্ড ধরে হাতের তালু, আঙুলের ফাঁক ও নখ ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে। সবচেয়ে ভালো চলমান পানির কলে হাত ধোয়া।
হাত ধোয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা শিশু বয়সে পারিবারিক পর্যায় থেকেই শুরু করা উচিত। যেহেতু হাত দিয়েই আমরা বেশির ভাগ কাজ করি, তাই নানা জীবাণুর সংস্পর্শেও আমাদের হাত বেশি আসে। আবার হাত দিয়ে আমরা নাক–মুখও বেশি স্পর্শ করি। তাই জীবাণুর সংক্রমণ থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে নিয়মিত হাত ধোয়া গুরুত্বপূর্ণ। খাবার তৈরি ও পরিবেশনের আগে অবশ্যই হাত ধোয়া উচিত। খাবার খেতে বসার সময় হাত ধুয়ে নিতে হবে। এ ছাড়া প্রস্রাব–পায়খানার পর সাবান দিয়ে ভালোমতো হাত ধোয়া জরুরি। ময়লা জিনিস স্পর্শ করার পর হাত ধুতে হবে। এসব অভ্যাস যদি নিয়মিত করা যায়, শ্বাসতন্ত্রের সংক্রামক রোগের পাশাপাশি অন্যান্য সংক্রামক রোগ, যেমন ডায়রিয়া, কলেরা, আমাশয়, জন্ডিস, টাইফয়েড, জিয়ার্ডিয়া, কৃমির মতো রোগবালাই থেকেও দূরে থাকা যায়।
অস্বাস্থ্যকর খাবার এড়িয়ে চলা
অস্বাস্থ্যকর বাইরের খাবার স্বাস্থ্য সুরক্ষায় একটা বড় বাধা। এ বাধা অতিক্রমের যে সু–অভ্যাস আমরা আয়ত্ত করেছিলাম, তা বজায় রাখতে পারলে সুস্বাস্থ্যের পথও সহজ হবে। রাস্তার পাশে বিক্রি হওয়া খোলা খাবারে সহজেই জীবাণু মেশে। এসব জীবাণু থেকে হতে পারে পেটের নানা রকম অসুখ। বাইরের অন্য অস্বাস্থ্যকর খাবারের মধ্যে আছে বেকারির তৈরি খাবার এবং নানা রকমের ফাস্ট ফুড। এসব খাবার ট্রান্সফ্যাটসমৃদ্ধ। ট্রান্সফ্যাট হলো স্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর চর্বি। অনেকে এসব খাবারে খুব আসক্ত। এসব খাবারের প্রভাবে শরীরের ওজন বাড়তে পারে। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদ্রোগ এবং মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের মতো অসুখের ঝুঁকি তৈরি করে এসব খাবার। বাইরের অনেক খাবারে ক্ষতিকর রাসায়নিক থাকে, যা লিভার, কিডনিসহ অন্যান্য অঙ্গের ক্ষতি করে। অনেক খাবার থেকে অ্যালার্জি এবং অ্যালার্জিজনিত অসুখ, যেমন অ্যাজমা বা হাঁপানি, রাইনাইটিস বা নাকের অসুখ, শরীরের চুলকানি—এসব হতে পারে। সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে বাইরের অস্বাস্থ্যকর খাবার এড়িয়ে চলার মতো সু-অভ্যাস অনেক টেকসই ও ফলপ্রসূ।