কী সেই পাঁচ নিয়ম, যেসব মেনে ওগিমির মানুষেরা হলেন শতবর্ষী
১০০ বছর বেঁচে থাকা এক ব্যক্তির মতে, তিনি এত বছর বেঁচে আছেন শুধু তাঁর ‘আঙুলগুলো’র কারণে। তিনি বলেন, ‘আপনার আঙুলগুলো ব্যস্ত রাখুন, এই ব্যস্ততাই আপনাকে বাঁচিয়ে রাখবে বহুদিন। সকালে ঘুম থেকে ওঠা, বাগান করা, একটু হেঁটে আসা, ব্যায়াম করা বা কাউকে সাহায্য করার মতো ছোট ছোট অভ্যাস আপনাকে ১০০ বছর পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখতে পারে।’
জাপানের ওগিমি নামের একটা গ্রাম আছে, যে গ্রামকে এখন বিশ্ববাসী চেনেন শতবর্ষের গ্রাম হিসেবে। এমনিতেই জাপানের মানুষের গড় বয়স বাকি দেশের মানুষের চেয়ে বেশি, তারপরও ওগিমি গ্রামটাকে আলাদা করে শতায়ুর গ্রাম বলে অভিহিত করার কারণ কী?
কারণ, পরিসংখ্যান। মাত্র ৩ হাজার মানুষের একটা গ্রামে যখন ১৫ জন মানুষের বয়স ১০০+ হয়, আর ৯০ বছর বয়স্ক মানুষের সংখ্যা হয় ১৭১, তখন এই গ্রাম এবং গ্রামের মানুষের প্রতি আলাদা করে নজর দিতেই হবে। ওগিমি গ্রামটা অবস্থিত জাপানের ওকিনাওয়া মেইন আইল্যান্ডে। গ্রামের প্রবেশপথে জাপানি ভাষায় লেখা, ‘৮০ বছর বয়সেও তুমি একজন তরুণ। ৯০ বছর বয়সে তোমার পূর্বপুরুষেরা যদি তোমাকে স্বর্গে দেখা করতে ডাকে, তবে তাদের বলে দিয়ো, ১০০ হওয়ার আগে স্বর্গদর্শনের কোনো ইচ্ছা তোমার নেই।’
এখন প্রশ্ন হতে পারে, এই গ্রামবাসীরা কি কোনো জাদুমন্ত্র জানেন? যে জাদুমন্ত্র বলে বুড়ো হয়েও থাকা যায় পুরোদস্তুর ইতিবাচক আর এনার্জেটিক। না, ওগিমির লোকজন কোনো জাদুমন্ত্র জানেন না, মানেনও না। তবে তাঁরা তাঁদের জীবন চালানোর ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম মেনে চলেন, সেগুলো তাঁদের পৌঁছে দেয় লম্বা এক জীবনের দোরগোড়ায়। চলুন জেনে নেওয়া যাক, তাঁদের জীবনের সেই সাধারণ ও কার্যকর নিয়মগুলো।
সব সময় চিন্তামুক্ত থাকা
ইকিগাই বইতে শতবর্ষী বেশ কিছু মানুষ সাক্ষাৎকারে লম্বা জীবনের প্রথম যে নিয়মের কথা বলেছেন, তা হলো, দুশ্চিন্তামুক্ত জীবনযাপন।
বেশি দিন বাঁচতে হলে জীবনে দুশ্চিন্তাকে কোনো আশ্রয় বা প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। চিন্তামুক্ত থাকতে হবে, ছোট ছোট জিনিসে খুশি হওয়া শিখতে হবে, কোনো পাওয়া না–পাওয়া নিয়েই খুব বেশি চিন্তা করার কিছু নেই।
প্রতিনিয়ত সুন্দর সুন্দর অভ্যাস গড়ে তোলা
১০০ বছর বেঁচে থাকা এক ব্যক্তির মতে, তিনি এত বছর বেঁচে আছেন শুধু তাঁর ‘আঙুলগুলো’র কারণে।
তিনি বলেন, ‘আপনার আঙুলগুলো ব্যস্ত রাখুন, এই ব্যস্ততাই আপনাকে বাঁচিয়ে রাখবে বহুদিন। এই ব্যস্ত থাকার জন্য আপনাকে সুন্দর সুন্দর অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। সকালে ঘুম থেকে ওঠা, বাগান করা, একটু হেঁটে আসা, ব্যায়াম করা বা কাউকে সাহায্য করার মতো ছোট ছোট অভ্যাস আপনাকে ১০০ বছর পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখতে পারে।’
বন্ধুত্ব ও সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করুন
ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি, সোশ্যাল মিডিয়া আর এআইয়ের এই যুগে মানুষ একা একাই সবকিছু করতে পারেন, ইউটিউব বা ফেসবুক দিয়ে পার করে ফেলেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
কিন্তু ওগিমির লোকজন এই ভার্চ্যুয়াল ফ্রেন্ডশিপ না, বরং গুরুত্ব দেন দৈনন্দিন বন্ধুত্ব আর সামাজিকতার ওপর। তাঁরা বিশ্বাস করেন, একা একা এক কাপ চা খাওয়ার চেয়ে বন্ধুর সঙ্গে এক কাপ চা খেলে সেটা আপনার দিনকে যেমন সুন্দর করতে পারে, জীবনকেও করে তুলতে পারে দীর্ঘায়িত।
তাড়াহুড়া না করা, শান্ত থাকা
যুগটাই আসলে গতির যুগ, ছুটে চলার যুগ। এই রেসের যুগে এসেও ওগিমির লোকজন আপনাকে বলবে, ‘ক্লান্ত পথিক, দুপুর রোদে গাছের নিচে একটু বসে জিরিয়ে নিয়ো। আমরা ব্যস্ত থাকব, কিন্তু তাড়াহুড়া করব না। চাপ নেব না। সময়ের আগে দৌড়াতে গিয়ে নিজেকে প্রেশারকুকারে ফেলার দরকার কী? তার চেয়ে বরং শান্ত থাকুন, ধীরে ধীরে বয়ে যেতে দিন সবকিছু। দেখবেন, আপনার জীবন সহজ হয়ে গেছে অনেকখানি।’
আশাবাদী আর ইতিবাচক থাকা
আরও একটা জানা কথা। কিন্তু মানা আর হয় কই? আধুনিক যুগে করোনার চেয়ে বড় মহামারির নাম ডিপ্রেশন। এই বিষণ্নতা যে শুধু মানসিকভাবেই আমাদের শেষ করে দেয়, তা নয়; বরং এই হতাশা শারীরিকভাবেও আমাদের অসুস্থ করে দেয়। ওগিমির শতবর্ষ পার করা লোকজনের মতে, বেশি দিন বাঁচতে হলে আপনাকে হতাশ হওয়া যাবে না, বরং জীবনের যেকোনো পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথের মতো বলতে হবে—
ওরে বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনই অন্ধ বন্ধ করো না পাখা..!
মোটামুটি এই পাঁচ নিয়ম ওগিমির গ্রামের মানুষদের জীবন যাপনের মূলনীতি। বছরের পর বছর ধরে এসব মানুষ এই নিয়ম মেনে চলছেন, পেয়েছেন লম্বা জীবনের খোঁজ।
এখন এই নিয়মগুলো মেনে চললেই কি আমি আপনিও ১০০ বছর বেঁচে থাকতে পারব?
না, বিষয়টা মোটেও এমন নয়। কারণ, বিশেষজ্ঞদের মতে, লাইফস্টাইল আর ডায়েট আপনার আয়ুর দুই–তৃতীয়াংশ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, বাকি এক–তৃতীয়াংশ নিয়ন্ত্রণ করে আপনার জেনেটিকস আর আশপাশের পরিবেশ।
১০০ না হোক, জীবনদর্শন পরিবর্তন করে, ওগিমির সাধারণ কিছু নিয়ম মেনে আমরা যদি আমাদের জীবনের মানটা আরেকটু উন্নত করতে পারি, আরও কিছু বছর বেশি বেঁচে থাকতে পারি, তাহলে মন্দ কী?