শিশুরা নানাভাবে অবহেলার শিকার হয়। এর বেশির ভাগই ঘটে অভাবের সংসারে মা–বাবার অগোচরে, যেমন দারিদ্র্যের কারণে মা–বাবা শিশুর মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হন। এতে শিশু হয়ে পড়ে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষাবঞ্চিত। আবার যেসব অভিভাবক নিজেরাই অযত্নে বড় হয়েছেন, তাঁদের অবহেলাতেও বেড়ে ওঠে অনেক শিশু।
শিশুকে অবহেলা বা তাকে অদ্ভুত ধরনের অত্যাচার করাকে বলা হয় ‘মুনসোসেন সিনড্রোম বাই প্রক্সি’
অবহেলায় যা হয়
অবহেলিত শিশুকে প্রয়োজনমতো ক্যালরি ও সুষম খাবার দেওয়া হয় না। তাতে খাদ্য উপাদানের একটি হয়তো অপ্রয়োজনীয়ভাবে বেশি হয়, অন্যটি কম। যেমন শিশুকে দিনভর শুধু দুধ ও দুগ্ধজাত ফর্মুলাতে রাখা হয়। তাতে সে আয়রন ঘাটতিজনিত রক্তস্বল্পতায় ভুগতে থাকে। হয়তো আজেবাজে খাইয়ে শিশুর পেট ভরানো হচ্ছে।
শিশু অপুষ্টিতে আক্রান্ত হয়। সঙ্গে ভোগে বদহজমে। দেখা যায়, উচ্চতা ও মাথার আকার স্বাভাবিকের কাছে থাকলেও শিশু থাকে হাড্ডিসার—ওজনে বেশ কম।
শিশুর পোশাকে থাকে শতচ্ছিন্ন অবস্থা। বেড়ে ওঠে স্বাস্থ্য অনুপযোগী বাড়িতে। শিশু থাকে শীতের কষ্টে। উষ্ণতার অভাবে বৃদ্ধি হয়
ধীরে বা কম।শিশুকে রোগপ্রতিরোধক টিকা দেওয়া হয় না। শিশু যে অসুস্থ, সেদিকেও খেয়াল থাকে না কিংবা শিশুকে চিকিৎসক দেখানো হলেও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা, ওষুধ সেবন ইত্যাদি যথাযথ হয় না।
১–৪ বছরের চঞ্চল শিশুকে সব সময় পাহারায় রাখতে হয়, যেমন আগুনের সংস্পর্শ, ওষুধ ও বিষদ্রব্য, সিঁড়িপথ ও অন্যান্য স্থান থেকে।
কিন্তু অবহেলার কারণে শিশুর নানা দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
লক্ষণ ও প্রতিকার
শিশুকে অবহেলা বা তাকে অদ্ভুত ধরনের অত্যাচার করাকে বলা হয় ‘মুনসোসেন সিনড্রোম বাই প্রক্সি’। এখানে শিশু অবহেলার শিকার হয় সূক্ষ্মভাবে, যার সরাসরি প্রমাণ থাকে না। যাঁরা বাচ্চার যত্ন নেওয়ার দায়িত্বে, তাঁদের দিয়েই শিশু হয় অত্যাচারিত।
এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি প্রতিদিন শিশুকে কোনো না কোনো উপসর্গ বা অসুখের জন্য হাজির করেন। সন্তানের অসুখকে গুরুতর হিসেবে সাজিয়ে বা শিশুর সমস্যাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন। কেউ কেউ বাচ্চাকে অসুস্থ করে তার নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ওষুধ প্রয়োগের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেন। এর মধ্য দিয়ে ওই অভিভাবক নিজের প্রতি সহানুভূতি লাভ করতে চান বা প্রার্থিত সহযোগিতা, এমনকি আর্থিক সুবিধাও লাভ করতে চান।
এ রোগের সম্পূর্ণ ইতিহাস জানা কঠিন। কেননা এখানে অত্যাচারের সময় ও স্থান নিয়ে সরাসরি স্বীকারোক্তি পাওয়া যায় না। পরিবারের অন্য সদস্যদের তথ্য, শিশুর যত্নে নিয়োজিত চিকিৎসকের ভাষ্য, অসুখের সঙ্গে শিশুর শরীরে দেখা দেওয়া উপসর্গের সঙ্গে অমিল ভাব এ রোগের ব্যাপারে সন্দেহ জাগাবে।
আর যদি দেখা যায়, শুধু প্রধান বা নির্দিষ্ট কোনো অভিভাবকের উপস্থিতিতেই শিশু সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছে ও তাঁর অনুপস্থিতিতে ভালো থাকছে অথবা শিশুকে যে চিকিৎসাই দেওয়া হোক না কেন, তা কার্যকর হচ্ছে না কিংবা বলা হচ্ছে, শিশু তা সহ্য করতে পারছে না, তবে ওই অভিভাবকের মুনসোসেন সিনড্রোম বাই প্রক্সি হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ আরও দৃঢ় হয়। তাই এর পরের কাজ, সন্দেহের নিরসন ঘটিয়ে সত্য উদ্ঘাটন।
অধ্যাপক ডা. প্রণব কুমার চৌধুরী, সাবেক বিভাগীয় প্রধান, শিশুস্বাস্থ্য বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল