বার্ধক্যের বিষণ্নতা কাটিয়ে উঠতে যা করা জরুরি
বার্ধক্যের বিষণ্নতার পরিণতি কত মর্মান্তিক হতে পারে, রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী সাদি মহম্মদের আত্মহত্যার ঘটনাটি আবারও আমাদের তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। পরিবার–অন্তঃপ্রাণ এই শিল্পীর মা জেবুন্নেছা সলিমউল্লাহ মারা যান গত বছরের জুলাই মাসে। এরপর মারা যান তাঁর বোন। এক বছরের কম সময়ে মা ও বোনের মৃত্যুতে হতাশায় ডুবে যান শিল্পী। পাশাপাশি তাঁর কর্মজীবন ঘিরেও হতাশার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। বার্ধক্যে হতাশা, বিষণ্নতা আসতে পারে নানা কারণে। ঠিক সময়ে চিকিৎসা নেওয়াটা তাই জরুরি।
চিকিৎসার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে মানুষের গড় আয়ু। সারা পৃথিবীতে বাড়ছে প্রবীণ নাগরিকদের সংখ্যা। প্রবীণদের স্বাস্থ্য নিয়ে আমরা যখন কথা বলি, তখন কেবল শারীরিক রোগ নিয়েই বেশি ভাবি। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদ্রোগের মতো দীর্ঘমেয়াদি রোগের দিকেই মনোযোগ থাকে বেশি। তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি কিন্তু বরাবরের মতো উপেক্ষিত থেকে যায়। একজন মানুষ যখন দীর্ঘ কর্মজীবন শেষে বার্ধক্যে উপনীত হন, যখন তাঁর আগের মতো ব্যস্ততা থাকে না, তখন নিজেকে গুটিয়ে ফেলেন। পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়েন, আর একসময়ের কর্মব্যস্ত মানুষটি খানিকটা একাকী হয়ে পড়েন। তখন শরীরের পাশাপাশি মনের স্বাস্থ্যেরও অবনতি ঘটে।
প্রবীণ বলতে আমরা সাধারণত ষাটোর্ধ্ব মানুষকেই বুঝি। কিন্তু মনে রাখতে হবে এই মানসিক স্বাস্থ্যের টানাপোড়েন কিন্তু মাঝবয়স থেকেই শুরু হয়ে যায়। মধ্যবয়সী মানুষের ভেতরে নানা ধরনের চাপ তৈরি হয়। কর্মজীবনের মধ্যগগনে থাকেন মাঝবয়সীরা, দায়িত্ব তাঁর ওপর অনেক বেশি থাকে। অনেকের প্রিয় স্বজনের মৃত্যু ঘটে, যা তাদের তীব্র শোকের মধ্যে ফেলে দেয়। অনেকে প্রিয়জন হারানোর বেদনা সইতে পারেন না, যাকে বলা হয় ‘অ্যাবনরমাল গ্রিফ রিঅ্যাকশন’। যার পরিণতিতে তৈরি হতে পারে আত্মহত্যার প্রবণতা। বাংলাদেশে জাতীয় পর্যায়ের গবেষণায় দেখা গেছে, প্রবীণদের মাঝে বিষণ্নতা তরুণদের চেয়ে বেশি।
কেন হয় বার্ধক্যে বিষণ্নতা
অবসর–পরবর্তী সামাজিক মর্যাদার পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে না পারা।
উপার্জন ও সামাজিক ক্ষমতা কমে যাওয়া।
ডায়াবেটিস, হৃদ্রোগ, উচ্চ রক্তচাপ বা ক্যানসারের মতো দীর্ঘমেয়াদি রোগ।
শিক্ষা, পেশাগত বা বৈবাহিক কারণে সন্তানদের দূরে চলে যাওয়া।
প্রিয় স্বজন, বিশেষ করে মা–বাবা, বড় ভাই বা বোনের মৃত্যু।
আগে থেকে বিষণ্নতা থাকলে বার্ধক্যে তা বেড়ে যাওয়া।
বয়সজনিত শারীরিক দুর্বলতা, যৌন দুর্বলতা ও একাকিত্ব।
কীভাবে বুঝবেন প্রবীণের বিষণ্নতা
তারুণ্য বা বার্ধক্য, বিষণ্নতার লক্ষণ কিন্তু প্রায় একই রকম। তবে প্রবীণদের মাঝে খিটখিটে মেজাজ বেশি হয়। রাগ নিয়ন্ত্রণ করার সক্ষমতা কমে যেতে পারে। বিষণ্নতার সাধারণ লক্ষণ হচ্ছে—
কমপক্ষে দুই সপ্তাহজুড়ে দিনের বেশির ভাগ সময় মন খারাপ থাকা।
কোনো কিছু করতে ভালো না লাগা।
মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, হঠাৎ রেগে যাওয়া।
আগে যেসব কাজ বা বিনোদন ভালো লাগত, এখন সেগুলো ভালো না লাগা।
মনোযোগ কমে যাওয়া।
ক্লান্তি বোধ করা।
ঘুমের সমস্যা।
রুচির সমস্যা (যেমন খেতে ইচ্ছা না করা, খিদে না থাকা বা বেশি বেশি খাওয়া)।
যেকোনো বিষয়ে মনোযোগ কমে যাওয়া।
ভুলে যাওয়া।
সব সময় মৃত্যুর চিন্তা করা।
নিজেকে অপরাধী ভাবা।
আত্মহত্যার চিন্তা ও চেষ্টা করা।
এমন কিছু শারীরিক সমস্যা, যার শারীরিক কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না।
বার্ধক্যে বিষণ্নতার চিকিৎসা
গত কয়েক দশকে মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসায় যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে। বিষণ্নতা চিকিৎসাযোগ্য রোগ। তবে সমস্যা হচ্ছে, আমরা কিন্তু খুব সহজে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যাই না। এটা নিয়ে আমাদের একধরনের সামাজিক ট্যাবু আর স্টিগমা আছে। বার্ধক্যে বিষণ্নতার চিকিৎসার জন্য কেবল ওষুধ যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন কাউন্সেলিং ও সামাজিক সহায়তা।
কী করণীয়
পরিবারের সদস্যরা বয়স্ক ব্যক্তিদের সঙ্গ দেবেন। মনে রাখবেন, তাঁদের কোনো ধরনের অবহেলা করা যাবে না। মানসিক সমর্থনটা এই বয়সে খুব জরুরি। বিষণ্নতা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা যেমন প্রবীণ ব্যক্তিকে দিতে হবে, তেমনি বিষণ্নতা রোগের লক্ষণগুলো পরিবারের সদস্যদের জানতে হবে। যদি দেখা যায় পরিবারের কোনো প্রবীণ সদস্য হঠাৎ নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছেন, একা থাকছেন, সামাজিক অনুষ্ঠানগুলো এড়িয়ে চলছেন, খাওয়া ও ঘুমের পরিবর্তন ঘটেছে, মনোযোগ কমে যাচ্ছে, তখন কিন্তু তাঁর প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে।
প্রয়োজন বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসা
মনে রাখতে হবে, বিষণ্নতা একটি মানসিক রোগ। সামাজিক সহায়তা এই রোগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা হলেও ওষুধ এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকাটা খুব জরুরি। এই রোগে যেমন ওষুধের প্রয়োজন, তেমনি দরকার কাউন্সেলিং। বিশেষ করে গুরুতর বিষণ্নতায় যেখানে আত্মহত্যার প্রবণতা রয়েছে। স্বজনেরা যদি সমবেদনা আর করুণা দেখিয়ে সামাজিক সহায়তা বেশি বেশি দিতে থাকেন, তখন কিন্তু আত্মহত্যার ঝুঁকি বাড়তে পারে। প্রবীণ বিষণ্ন ব্যক্তিটি নিজেকে অপরের দয়া আর করুণার পাত্র ভাবতে পারেন। সমবেদনার বদলে তাঁর প্রতি সমানুভূতি দেখাতে হবে। তাঁর ভেতরের আত্মশক্তি বাড়াতে হবে। বিষণ্নতায় আক্রান্ত ব্যক্তিকে যদি বারবার বলা হয় ‘আপনি কেন বিষণ্ন হচ্ছেন, আপনি বিষণ্ন হবেন না’, ‘এই সামান্য কারণে মন খারাপ করলেন কেন’ তাহলে কিন্তু তাঁর বিষণ্নতা আরও বাড়তে পারে। পরিবারের কোনো বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যের মধ্যে যদি নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া, মরে যাওয়ার কথা বলার মতো লক্ষণ দেখা যায়, তখন অবশ্যই তাঁকে মানসিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে নেওয়ার জন্য স্বজনদের উদ্যোগী হতে হবে। বিষণ্নতা একটি মানসিক রোগ এবং এ জন্য আছে বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসা। উপযুক্ত সময়ে চিকিৎসা গ্রহণ করলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিষণ্নতা ভালো হয়, যার মধ্য দিয়ে আত্মহত্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব।