শিশুর জ্বরজনিত খিঁচুনি হলে যা করবেন, যা করবেন না
শিশুদের জ্বর আসাটা অস্বাভাবিক নয়। শিশুদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা দুর্বল বলে নানা ধরনের ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা জীবাণু আক্রমণ করে বেশি। ফলে জ্বর হয়। কিন্তু জ্বরের সঙ্গে যদি খিঁচুনি হয়, তাহলে অভিভাবকদের মনে যে কী মাত্রায় ভীতি আর দুশ্চিন্তার উদ্রেক করে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
জ্বরের সঙ্গে খিঁচুনি বিভিন্ন কারণে হতে পারে। সাধারণত যেসব জ্বরে মস্তিষ্কে প্রদাহ হয়, যেমন মেনিনজাইটিস, এনকেফালাইটিস, সেরেব্রাল ম্যালেরিয়ায় জ্বরে সঙ্গে খিঁচুনি থাকে। বেশ কিছু জিনগত সমস্যায় জ্বরের সঙ্গে খিঁচুনি হতে পারে। তেমনই আগে থেকেই এপিলেপসি রোগে আক্রান্ত শিশুর জ্বর হলেও আগের নিয়ন্ত্রিত খিঁচুনি বেড়ে যেতে পারে।
তবে জ্বরের সঙ্গে খিঁচুনির সবচেয়ে সাধারণ কারণ হলো ফেব্রাইল কনভালশন বা শিশুর জ্বরজনিত খিঁচুনি। আঞ্চলিক ভাষায় অনেকে ‘জ্বরচুম্বক’ও বলে থাকেন। ২-৫ শতাংশ সুস্থ শিশু ৬-৬০ মাস বয়সের মধ্যে এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। ১২-১৮ মাস বয়সী শিশুদের মধ্যে এর হার বেশি দেখা যায়। পরিবারে কারও এই রোগ থাকলে সেই পরিবারে শিশুদের ফেব্রাইল কনভালশনে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি দেখা যায়।
লক্ষণ
১. শিশুর জ্বর ১০০ দশমিক ৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট (৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস) অথবা এর বেশি হওয়া।
২. জ্বরের প্রথম ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সাধারণত খিঁচুনি হয় এবং ১৫ মিনিটের বেশি থাকে না। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে খিঁচুনির পুনরাবৃত্তি হয় না।
৩. খিঁচুনির সময় শিশু হাত-পা শক্ত করে বারবার ঝাঁকুনি দিতে পারে, খিঁচুনির পর শিশুর জিবে কামড় লাগতে পারে, শিশু কিছু সময়ের জন্য অজ্ঞান অথবা দুর্বল হয়ে যেতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রস্রাব-পায়খানাও করে দিতে পারে।
৪. সাধারণত কিছুক্ষণ পরই শিশু আবার স্বাভাবিকভাবে হাসিখুশি হয়ে যায়।
তবে শিশুর খিঁচুনি হতে দেখলে কোনো অভিভাবকেরই মাথা ঠিক থাকে না। তাই সে সময় আতঙ্কিত হওয়া চলবে না।
যা করা উচিত
১. শিশুকে নরম কোনো কিছুর ওপর বাঁ পাশে কাত করে রাখুন, যেন মুখ থেকে লালা বেরিয়ে যেতে পারে।
২. শিশু আঘাত পেতে পারে এমন বস্তু বা জায়গা থেকে সরিয়ে রাখুন।
৩. খিঁচুনি কতক্ষণ স্থায়ী থাকে, সেটা লক্ষ করুন। সাধারণত পাঁচ মিনিটের বেশি খিঁচুনি থাকে না। এর বেশি হলে অবশ্যই কাছের হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে এবং ওষুধের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
৪. সম্ভব হলে খিঁচুনির ভিডিও করে রাখুন, যা পরে শিশুর চিকিৎসার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক হবে।
৫. চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী জ্বরের চিকিৎসা নিন। ক্ষেত্রবিশেষে জ্বরের সঙ্গে খিঁচুনি হলে পিঠ থেকে রস (সেরেব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড) নিয়ে পরীক্ষা করতে হতে পারে।
যা কখনোই করবেন না
১. শিশুর দুই দাঁতের পাটির মাঝখানে আঙুল, চামচ বা অন্য কোনো বস্তু দেবেন না।
২. খিঁচুনিরত অবস্থায় কোনো কিছু খাওয়ানোর চেষ্টা করবেন না।
৩. শিশুকে জোর করে চেপে ধরে অথবা মাথায় পানি ঢেলে খিঁচুনি বন্ধ করার চেষ্টা করবেন না।
চিকিৎসা
১. রোগের নামের সঙ্গেই তার চিকিৎসা দেওয়া আছে, ‘জ্বরজনিত খিঁচুনি’ মানে সবার আগে জ্বরের চিকিৎসা করতে হবে।
২. খিঁচুনি বন্ধের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ডায়াজিপাম গ্রুপের ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করা হয়।
৩. চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে জ্বর ও খিঁচুনির কারণ বের করে তার চিকিৎসাও করতে হবে।
প্রতিরোধ
১. ফেব্রাইল কনভালশন রোগে আক্রান্ত শিশুদের জ্বর হওয়ামাত্রই শিশুর বয়স এবং ওজন অনুযায়ী প্যারাসিটামল খাইয়ে জ্বর কমাতে হবে।
২. যেকোনো সময় শিশুর জ্বর হতে পারে, তাই অভিভাবকদের সতর্ক থাকতে হবে যেন জ্বর আসামাত্রই তা কমানোর ব্যবস্থা নেওয়া যায়।
৩. এ রোগে আক্রান্ত শিশুকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে গেলে সঙ্গে প্যারাসিটামল সিরাপ এবং খিঁচুনি বন্ধের জন্য চিকিৎসকের দেওয়া ব্যবস্থাপত্র রাখতে হবে।
ভবিষ্যতে মৃগীরোগ হওয়ার ঝুঁকি
ফেব্রাইল কনভালশন থেকে মস্তিষ্কের সাধারণত ক্ষতি হয় না। পরবর্তী সময়ে এপিলেপসি বা মৃগীরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি একদমই কম। তবে কিছু বিষয় খেয়াল করুন—
১. শিশুর যদি স্নায়ুর বিকাশজনিত সমস্যা থাকে, ২. পরিবারে কারও মৃগী রোগ থাকে, ৩. জ্বরের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে একাধিকবার অথবা একবারে ১৫ মিনিটের বেশি খিঁচুনি হয়, ৪. হাত-পায়ের বদলে যেকোনো এক পাশে খিঁচুনি হতে থাকে, তাহলে এই শিশুরা পরবর্তী সময়ে এপিলেপসিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। আতঙ্কিত না হয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী শিশুর জ্বর কমিয়ে ফেব্রাইল কনভালশন নিয়ন্ত্রণে রাখা খুবই সম্ভব। তবে ৬ বছরের বেশি বয়সীদের জ্বরের সঙ্গে খিঁচুনি হলে অবশ্যই শিশু স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।
ডা. ফারাহ দোলা: বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর