নারীরা যেসব হরমোনজনিত সমস্যায় বেশি ভোগেন
হরমোনজনিত সমস্যা নারীদেরই বেশি হতে দেখা যায়। অথচ হরমোনজনিত অনেক রোগ বা পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁরা সচেতন নন। সে কারণে তাঁদের ভুগতেও হয় বেশি। নারীদের সাধারণ কিছু হরমোনজনিত রোগ সম্পর্কে জানা যাক
নারীর জীবনজুড়েই চলে হরমোনের খেলা। বয়ঃসন্ধিকালের পরিবর্তন, কিশোরীর রজঃস্বলা হওয়া, তারপর সন্তান ধারণ, বুকে দুধ আসা, মধ্যবয়সের সংকট, পঞ্চাশে রজঃনিবৃত্তি—প্রতিটি পর্যায়েই নারীর শরীর–মনকে নিয়ন্ত্রণ করে নানা রকমের হরমোন। তাই হরমোনজনিত সমস্যাও নারীদেরই বেশি হতে দেখা যায়।
হরমোন কী
হরমোন হলো শরীরের বিভিন্ন গ্রন্থি বা গ্ল্যান্ড থেকে নিঃসৃত বিশেষ ধরনের কেমিক্যাল মেসেঞ্জার বা বার্তাবাহক, যা রক্তের মাধ্যমে দেহের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে প্রবাহিত হয়ে নানা রকম প্রভাব সৃষ্টি করে। আমাদের মস্তিষ্কের ভেতরকার হাইপোথ্যালামাস ও পিটুইটারি থেকে শুরু করে গলার থাইরয়েড, প্যারাথাইরয়েড, পেটের মধ্যকার অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি হয়ে তলপেটে ওভারি বা ডিম্বাশয় পর্যন্ত সারা শরীরজুড়েই রয়েছে নানা ধরনের গ্রন্থি। আর এসব গ্রন্থি থেকে প্রতিমুহূর্তে তৈরি হচ্ছে নানা রকম হরমোন।
হরমোনের সমস্যা কেন হয়
হরমোনের সমস্যাগুলোকে মোটাদাগে দুই ভাগে ভাগ করা যায়।
১. প্রয়োজনের তুলনায় কম হরমোন তৈরি হওয়া।
২. প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত হরমোন তৈরি হওয়া। এর বাইরে গ্রন্থিগুলোয় হতে পারে সংক্রমণ, প্রদাহ, এমনকি টিউমার বা ক্যানসার। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হরমোনজনিত সমস্যাগুলো হয়ে থাকে অটোইমিউন রোগের কারণে। মানে দেহের ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধক্ষমতার ভুলের কারণে। এর বাইরে নানা ধরনের ভাইরাস সংক্রমণ, টিবি বা প্রদাহ দায়ী হতে পারে। হরমোনের ভারসাম্যহীনতার জন্য দায়ী মন্দ খাদ্যাভ্যাস, স্থূলতা, রাত জাগা বা কায়িক শ্রমহীনতার মতো বিষয়গুলোও। কখনো নানা ধরনের ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায়ও হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে।
নারীদের সাধারণ কিছু হরমোনজনিত রোগ
থাইরয়েডজনিত রোগ
থাইরয়েড আমাদের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি গ্রন্থি। এটি থাকে গলার সামনের দিকে। এই গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হরমোন শারীরিক ও মানসিক বিকাশ, বিপাকক্রিয়াসহ দেহের প্রায় সব কর্মকাণ্ডে প্রভাব ফেলে। গর্ভাবস্থায় নারীর থাইরয়েড হরমোন গর্ভস্থ শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাই থাইরয়েড হরমোনের ঠিকঠাক কার্যকলাপ নারীদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।
থাইরয়েড হরমোনের ঘাটতি হলে বলে হাইপোথাইরয়েডিজম আর বাড়তি হলে বলে হাইপারথাইরয়েডিজম। দুটি রোগই পুরুষদের তুলনায় নারীদের কয়েক গুণ বেশি হতে দেখা যায়।
হাইপোথাইরয়েডিজম হলে ওজন বৃদ্ধি, শুষ্ক ত্বক, চুল পড়া, শীত শীত ভাব, কোষ্ঠকাঠিন্য, ক্লান্তি ও অবসাদ, ঘুম ঘুম ভাব, অতিরিক্ত বা অনিয়মিত মাসিক, বন্ধ্যত্ব বা বারবার গর্ভপাত প্রভৃতি সমস্যা দেখা দেয়।
আর হাইপারথাইরয়েডিজম হলে ওজন হ্রাস, ডায়রিয়া, বুক ধড়ফড়, অতিরিক্ত গরম লাগা ও ঘাম হওয়া, মাসিক বন্ধ, বন্ধ্যত্ব, হাত কাঁপা ইত্যাদি হয়।
কখনো হরমোনের মাত্রা ঠিক থাকার পরও থাইরয়েড ফুলে যেতে পারে, যাকে বলে গলগণ্ড বা গয়টার। আবার থাইরয়েডে নডিউল বা গোটা থেকে ক্যানসারও হতে পারে। এ ছাড়া থাইরয়েড গ্রন্থিতে হতে পারে প্রদাহ বা সংক্রমণ। গর্ভাবস্থায় এবং সন্তান নেওয়ার পরিকল্পনা থাকলে প্রত্যেক নারীর থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা পরীক্ষা করা বাধ্যতামূলক। কারণ, আগেই বলেছি, গর্ভাবস্থায় থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা এদিক-ওদিক হলে গর্ভস্থ শিশুর ওপর তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। হতে পারে নানা জটিলতা।
পিসিওএস
পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম বা পিসিওএস কৈশোরকালের একটি সমস্যা। এ সমস্যা হলে রক্তে পুরুষ হরমোন বা অ্যান্ড্রোজেনের মাত্রা বেড়ে যায়। ফলে কিশোরীর মাসিক অনিয়মিত হয়ে পড়ে, অবাঞ্ছিত লোম দেখা দেয়, ঘাড়ে কালো দাগ, চুল পড়া, মুখে ব্রণসহ নানা সমস্যা হতে থাকে। পরবর্তী সময়ে এই মেয়েদের বন্ধ্যত্ব হতে পারে। এই রোগের অন্যতম প্রধান কারণ অল্প বয়সে মুটিয়ে যাওয়া বা স্থূলতা। ওজন কমাতে পারলে এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম করতে পারলে অনেকটাই মুক্তি মেলে। তার সঙ্গে সমস্যা অনুযায়ী চলবে চিকিৎসা।
অ্যাড্রেনাল গ্রন্থির সমস্যা
কিডনির মাথার ওপর টুপির মতো এক জোড়া গ্রন্থি আছে, এগুলোই অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি। এই গ্রন্থি থেকে তৈরি হয় কর্টিসোল, অ্যালডোস্টেরন, ক্যাটেকোলামাইনসহ নানা হরমোন। অ্যাড্রেনাল গ্রন্থিতে টিউমার হলে বা এটি ফুলে গেলে অতিরিক্ত হরমোন তৈরি হতে পারে। তখন শরীর ফুলে যাওয়া, মুখ ফোলা, পেট মোটা হয়ে যাওয়া, পেটের ত্বকে গোলাপি দাগ, অবাঞ্ছিত লোম, অনিয়মিত মাসিক, রক্তচাপ বেড়ে যাওয়াসহ নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। সাধারণত অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে টিউমার ফেলে দেওয়াই হলো এর সমাধান।
অপর দিকে অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি থেকে হরমোন কম তৈরি হওয়াকে বলে অ্যাড্রেনাল ইনসাফিসিয়েন্সি বা অ্যাডিসন ডিজিজ। এতে ওজন হ্রাস, ক্লান্তি, অরুচি, রক্তচাপ কমে যাওয়া, রক্তে লবণের ঘাটতিসহ নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। তখন হরমোন প্রতিস্থাপন করে এর চিকিৎসা করা হয়।
ডায়াবেটিস
প্যানক্রিয়াস গ্রন্থি থেকে ইনসুলিন তৈরিতে সমস্যা বা কোষের মধ্যে ইনসুলিন অকার্যকারিতাই ডায়াবেটিসের জন্য দায়ী। ডায়াবেটিস নারী-পুরুষ উভয়েরই সমান হারে হয়ে থাকে কিন্তু নারীদের এক বিশেষ ধরনের ডায়াবেটিস হয়, যার নাম গর্ভকালীন ডায়াবেটিস বা জেসটেশনাল ডায়াবেটিস। এ ধরনের ডায়াবেটিস কেবল গর্ভাবস্থায় দেখা দেয় এবং সন্তান প্রসবের পর সাধারণত সেরে যায়। গর্ভাবস্থায় নানা হরমোনের মাত্রা বেড়ে যাওয়াই এর কারণ। এ ছাড়া সন্তান ধারণকালে অতিরিক্ত ওজন, পরিবারে ডায়াবেটিসের ইতিহাস, আগের সন্তান ধারণকালে ডায়াবেটিসের ইতিহাস, পিসিওএসের ইতিহাস থাকলে ঝুঁকি বাড়ে। গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস মা ও শিশু দুজনেরই নানা জটিলতা ডেকে আনতে পারে। তাই এ সময় একজন স্ত্রীরোগবিশেষজ্ঞের পাশাপাশি হরমোন বিশেষজ্ঞ এবং পুষ্টিবিদের তত্ত্বাবধানে থাকতে হবে। সন্তান প্রসবের পর বেশির ভাগ সময় সেরে গেলেও পরবর্তী সময়ে ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি এদের অত্যন্ত বেশি। তাই স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম ও সঠিক ওজন বজায় রাখার চেষ্টা চলমান রাখতে হবে।
অস্টিওপোরোসিস
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নারীর হাড় ভঙ্গুর হয়ে যেতে থাকে। একে বলে অস্টিওপোরোসিস। অস্টিওপোরোসিসের হার পুরুষের তুলনায় নারীদের অনেক বেশি। আর এ কারণে বয়স্ক নারীদের হাড় ভাঙার ঘটনাও বেশি ঘটে। হাড়ে খনিজ ক্যালসিয়ামের অভাবই এর কারণ। অস্টিওপোরোসিস প্রতিরোধে অল্প বয়স থেকেই মেয়েদের ক্যালসিয়ামযুক্ত খাবার (যেমন দুধ, দই, সবুজ শাকসবজি, ছোট মাছ) খেতে হবে। সূর্যের আলোয় থাকে ভিটামিন ডি, যা ক্যালসিয়াম শোষণে সাহায্য করে এবং হাড় মজবুত করে। মেয়েদের তাই কৈশোর থেকেই সূর্যের আলোয় খেলাধুলা, হাঁটা বা ব্যায়ামের সুযোগ করে দিতে হবে। গর্ভাবস্থায় ও স্তন্যদানের সময় উচ্চ ক্যালসিয়ামযুক্ত খাবারের পাশাপাশি ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট দরকার হয়। অস্টিওপোরোসিসের প্রবণতা সবচেয়ে বাড়ে মেনোপজের পর। কারণ, এ সময় নারী হরমোন ইস্ট্রোজেনের পড়তি হাড়কে ভঙ্গুর করে ফেলে। মেনোপজের আগে–পরে তাই স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও নিয়মিত ব্যায়াম জরুরি। অস্টিওপোরোসিস শনাক্ত হলে তার সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা আছে, যা হাড় ভাঙা থেকে বয়স্ক নারীকে রক্ষা করতে পারে।
মেনোপজ
৪৫ থেকে ৫৫ বছর বয়সে মেনোপজ বা রজঃনিবৃত্তি ঘটলেও কারও কারও এর আগে থেকেই মেনোপজের লক্ষণগুলো প্রকাশ পেতে থাকে। হট ফ্লাশ বা অতিরিক্ত গরম লাগা, হঠাৎ কান–মাথা গরম হয়ে ওঠা, ক্লান্তি ও অবসাদ, ইনসমনিয়া, মেজাজ খিটখিটে হয়ে পড়া—এসব নানা উপসর্গ এই বয়সী নারীদের জীবন দুর্বিষহ করে তোলে। অধিকাংশ নারীই মেনোপজের পরিবর্তনগুলো সম্পর্কে সচেতন নন, তাই বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দিলেও তার জন্য চিকিৎসকের কাছে যান না। একা একাই কষ্ট পান।
মেনোপজের সময় থেকে নারীদের ওজন বাড়া, রক্তের ক্ষতিকর চর্বি বাড়া, হৃদ্রোগের ঝুঁকি বাড়ার প্রবণতা দেখা দেয়। তাই এ সময় স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন করা উচিত। খাদ্যাভ্যাসে ইতিবাচক পরিবর্তন, নিয়মিত হাঁটা ও ব্যায়াম, সচল ও কর্মক্ষম থাকা, এ সময় মাঝেমধ্যে সুগার, রক্তচাপ, কোলেস্টেরল ইত্যাদি চেকআপ করা উচিত। হট ফ্লাশ বা বারবার প্রস্রাবে সংক্রমণ কিংবা শুষ্ক ভ্যাজাইনার মতো সমস্যার সুচিকিৎসা আছে, প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ পরামর্শ নিতে হবে।
নানা হরমোনের মাত্রার ওঠানামায় নারীর শরীর ও মনে একের পর এক আসে নানা পর্যায়—পিরিয়ড, প্রজনন, ব্রেস্ট ফিডিং ও মেনোপজ। প্রভাব ফেলে তাঁর দৈনন্দিন জীবনে, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর। তাই প্রত্যেক নারীর উচিত জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে এসব সমস্যা মোকাবিলার জন্য সচেতন হওয়া। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া। স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম, সঠিক ওজন বজায় রাখা, রাতে পর্যাপ্ত ঘুম এবং চাপমুক্ত জীবনযাপন এ ধরনের সমস্যা থেকে দূরে রাখতে সাহায্য করবে আপনাকে। তাই নিজের যত্ন নিন, নিজেকে গুরুত্ব দিন।
ডা. তানজিনা হোসেন, অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি ও মেটাবলিজম বিভাগ, গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজ