নারীরা পুষ্টির ঘাটতি পূরণে কী খাবেন
নিজের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিষয়ে এখনো অনেক অসচেতন এ দেশের নারীরা। পরিবারের সবাইকে খাইয়ে তাঁরা খান, প্রতিদিন রান্না হওয়া খাবারের বিশেষ অংশ পরিবারের পুরুষ ও সন্তানদের জন্য তুলে রাখেন তাঁরা। এভাবে নিয়মিত ভালো ও পুষ্টিকর খাবার থেকে বঞ্চিত হয় নারীর শরীর।
আধুনিক কর্মজীবী নারীও ঘরসংসার–কাজের জায়গা সামলাতে গিয়ে নিজের খাবারের প্রতি মনোযোগ দেন কম। হাতের কাছে চটজলদি খাবার, যেমন বাইরের প্যাকেটজাত খাবার, প্রক্রিয়াজাত খাবার ও রেস্টুরেন্টের খাবার খেয়ে থাকেন। দীর্ঘদিন ধরে চলা এ ধরনের খাদ্যাভ্যাস থেকে দেখা দেয় পুষ্টির ঘাটতি। যে কারণে নারীরা নানা রকম রোগে ভোগেন। পুষ্টির ঘাটতি পূরণ করে শরীর ফিট রাখতে নারী–পুরুষ–শিশুনির্বিশেষে সবাইকে পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে।
আসুন জেনে নেওয়া যাক সুস্থ থাকতে নারীদের কেমন খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা জরুরি।
গোটা শস্য ও সিরিয়াল
গোটা শস্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করে। গোটা শস্যের তুষ ও ফাইবার স্টার্চের গ্লুকোজের ভাঙনকে ধীর করে, ফলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে। এ ছাড়া গোটা শস্যের ফাইবারগুলো কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে বলে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ হয়। এ জন্য খাদ্যতালিকায় রাখতে হবে লাল চাল, লাল আটা, ওটস, বার্লি ইত্যাদি। গবেষণা বলছে, যেসব নারী খাবারে প্রতিদিন কমপক্ষে চারটি গোটা শস্যকে অগ্রাধিকার দেন, তাঁদের গর্ভধারণের সম্ভাবনা বাড়ে। গোটা শস্য–জাতীয় খাবারের মধ্যে ফাইটিক অ্যাসিড, ভিটামিন ই, সেলেনিয়ামের মতো অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট থাকে, যা নারীদের প্রদাহ নিয়ন্ত্রণ করে অস্টিওপোরোসিস নিয়ন্ত্রণে কাজ করে।
দুধ ও দুধজাত খাবার
দুধ ও দুধের তৈরি খাবার ক্যালসিয়ামের চমৎকার উৎস। নারীর হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্য যা প্রয়োজনীয়। মাঝবয়সের পর নারীদের মধ্যে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি দেখা দেয়। মেনোপোজের সময় নারীদের অস্টিওপোরোসিস ও ক্যালসিয়াম–সম্পর্কিত অন্যান্য সমস্যার ঝুঁকি কমাতে ক্যালসিয়াম গ্রহণের পরিমাণ বাড়াতে হবে। থাইরয়েডের সমস্যা নারীদেরই বেশি হয়, যা থেকে দেখা দিতে পারে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি। এ ছাড়া হাড় ও দাঁত ঠিক রাখতে খাদ্যতালিকায় ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ খাবার, যেমন কম চর্বিযুক্ত দুধ, দই ও পনির অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। মনে রাখতে হবে, ক্যালসিয়ামের সঠিক শোষণের জন্য ভিটামিন ডি ঠিকমতো পাচ্ছে কি না, সেদিকেও খেয়াল রাখা জরুরি।
বিভিন্ন রকম বাদাম
বাদামকে বলা হয় পুষ্টির আধার। এতে আছে ভিটামিন ই, ম্যাগনেশিয়াম, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ম্যাঙ্গানিজসহ নানা পুষ্টি উপাদান, যা নারীর হাড়ের স্বাস্থ্য ও পেশির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। নারীদের মাসিক শুরু হওয়া থেকে মেনোপোজ পর্যন্ত হরমোন ওঠানামা করে। এই হরমোন নিয়ন্ত্রণে বাদামের অনেক ভূমিকা রয়েছে। এ ছাড়া বাদামে রয়েছে ওমেগা থ্রি ও ওমেগা সিক্স ফ্যাটি অ্যাসিড। বাদাম প্রিমেনস্ট্রুয়াল সিনড্রোমের লক্ষণ কমাতে সাহায্য করে। এই ফ্যাটি অ্যাসিডগুলো মেজাজ, ঘুম এবং সামগ্রিক সুস্থতাকেও প্রভাবিত করে। বাদাম আয়রনের মাত্রা বজায় রাখতেও সাহায্য করে। বিশেষ করে মাসিক, গর্ভাবস্থা ও বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় নারীর ডায়েটে পেস্তাবাদাম রাখলে আয়রনের মাত্রা বাড়ে। বাদাম ফোলেটসমৃদ্ধ বি ভিটামিন, যা গর্ভাবস্থায় মায়ের শক্তি বাড়ায়, শিশুর জন্মগত ত্রুটি প্রতিরোধ করে। আখরোটে অন্যান্য বাদামের চেয়ে ভিটামিন ই বেশি, যা নারীদের ফার্টিলিটি বাড়াতে সাহায্য করে।
চর্বিযুক্ত মাছ
চর্বিযুক্ত মাছের মধ্যে আছে ইলিশ, রুপচাঁদা, পাঙাশ, রুই, ম্যাকরেল, স্যামন, টুনা ইত্যাদি। এগুলো মূলত ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড। এই ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড হলো পলি আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিডের একটি গ্রুপ, যা নারীর স্বাস্থ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে; বিশেষ করে নারীদের মাসিকের ব্যথা ও মেনোপোজের উপসর্গ কমাতে সাহায্য করে। এ ছাড়া ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিডে প্রদাহবিরোধী বৈশিষ্ট্য থাকায় মাঝবয়সী নারীদের রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস উপশম করে এবং আলঝেইমার, স্মৃতিশক্তি ও মেজাজের উন্নতি করে।
বেরি–জাতীয় খাবার
প্রতিবছর পুরুষদের তুলনায় নারীরা হৃদ্রোগে বেশি মারা যান। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রচুর পরিমাণে ফ্ল্যাভোনয়েড ধারণকারী খাদ্য প্রদাহ, কার্ডিওভাসকুলার রোগের ঝুঁকি, রক্ত জমাট বাঁধা ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়। নানা রকম ফল ও সবজিতে মেলে ফ্ল্যাভোনয়েড। তবে প্রাকৃতিক এই যৌগগুলো প্রচুর পরিমাণে থাকে বেরিতে। এ ছাড়া আমেরিকান জার্নাল অব ক্লিনিক্যাল নিউট্রশন–এ প্রকাশিত একটি গবেষণা বলছে, যাঁরা সবচেয়ে বেশি ব্লুবেরি খেয়েছেন, তাঁদের ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি না খাওয়া মানুষের তুলনায় ২৩ শতাংশ কম ছিল। প্রতিদিন যাঁরা অন্তত একটি বেরি–জাতীয় খাবার খেয়েছেন, তাঁদের উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমে গেছে ৪ শতাংশ। বেরি–জাতীয় খাবারে ক্যানসার প্রতিরোধকারী এলাজিক অ্যাসিডও বেশি দেখা যায়, যা ক্যানসার কোষের বৃদ্ধি বন্ধ করতে সাহায্য করে।
সবুজ শাকসবজি
গাঢ় পাতাযুক্ত শাকসবজিতে প্রয়োজনীয় ভিটামিন, যেমন ভিটামিন এ, সি, ই, কে এবং খনিজ পদার্থ, যেমন ক্যালসিয়াম, আয়রন ও ফাইবার আছে পরিপূর্ণভাবে। এগুলো মেয়েদের ওজন, কোলেস্টেরল, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণসহ নানা উপকার করে। বিশেষ করে সবুজ শাকে ফোলেট রয়েছে, যা একধরনের বি ভিটামিন। এটি মায়ের গর্ভাবস্থায় শিশুর জন্মগত ত্রুটি থেকে রক্ষা করে। কিশোরীদের প্রতিদিন আড়াই থেকে তিন কাপ শাকসবজি খাওয়া উচিত। এতে শারীরিক বৃদ্ধির সঙ্গে মানসিক চাপও কমে।