ডেঙ্গু পরিস্থিতিতে আপনি কতটা সচেতন?
লাগামহীনভাবে বাড়ছে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা। সঙ্গে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে এতে মৃত্যুর সংখ্যাও। প্রথমবারের মতো দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপে আবির্ভূত হয় ২০১৯ সালে। সেবার রাজধানী ঢাকার ৯৮টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২১টি ওয়ার্ড ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিতে ছিল। কিন্তু এবার পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, এ বছর ঢাকার দুটি সিটি করপোরেশনের মোট ৯৮টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৫৫টিই ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিতে আছে। ডেঙ্গুর এই ভয়াবহতার মধ্যে আপনি কতটা সচেতন। নিজেকে নিরাপদ রাখতে জেনে রাখুন কিছু জরুরি তথ্য।
ডেঙ্গু কী, কোন অঞ্চলে বেশি হয়
ডেঙ্গু ভাইরাসজনিত সংক্রামক রোগ, যা সাধারণত স্ত্রী মশা থেকে মানবদেহে বাহিত হয়। চার ধরনের ভাইরাস এই সংক্রমণের জন্য দায়ী। প্রধানত বাংলাদেশ, ভারত ও সিঙ্গাপুরের মতো গ্রীষ্ণমণ্ডলীয় দেশ বা অঞ্চলগুলোতে ভাইরাসজনিত এই রোগের প্রকোপ বেশি। যে অঞ্চলের জলবায়ুতে গ্রীষ্মকালের প্রভাব বেশি, সে অঞ্চলকে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চল বলে। এই দেশ বা অঞ্চলসমূহের শহর এবং উপশহরগুলোতেই ডেঙ্গু বেশি সংক্রমিত হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বর্তমানে প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী প্রায় ১০-৪০ কোটি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন এবং পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে আছেন।
ডেঙ্গু যেভাবে সংক্রমিত হয়
ডেঙ্গু কয়েকভাবে সংক্রমিত হতে পারে। এর মধ্যে ভাইরাস বাহক মশার কামড়ে সংক্রমণ তো হয়ই, এ ছাড়া আক্রান্ত ব্যক্তিকে কামড়ে দেওয়ার ফলে ভাইরাস বাহক হয়ে ওঠা মশার কামড় অন্যতম। অন্তঃসত্ত্বা মায়ের মাধ্যমে গর্ভাবস্থায় নবজাতকও ভাইরাসের কবলে পড়ে। আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত নেওয়া, অঙ্গদান ইত্যাদি কারণেও ডেঙ্গুর ভাইরাস সংক্রমিত হয়।
আক্রান্ত হয়েছেন কি না, তা বুঝবেন যেভাবে
বেশির ভাগ আক্রান্তের ক্ষেত্রে ডেঙ্গুর খুব সামান্য কিছু উপসর্গ দেখা দেয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে উপসর্গই দেখা যায় না। আক্রান্ত ব্যক্তি সাধারণত ১ থেকে ২ সপ্তাহের মধ্যে সুস্থ হয়ে ওঠেন। আক্রান্ত হলে হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নেওয়ার দরকারও হয়। তবে সংক্রমণ মারাত্মক পর্যায়ে চলে গেলে তা হয়ে পড়ে মৃত্যুর কারণ।
আক্রান্ত হওয়ার ৪-১০ দিনের মধ্যে এই রোগের লক্ষণগুলো দেখা যায়। লক্ষণ দেখা দেওয়ার ২-৭ দিনের মধ্যে শরীর থেকে তা আবার চলেও যায়।
সাধারণ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে যেসব লক্ষণ দেখা যায়—
তীব্র জ্বর (শরীরের তাপমাত্রা ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট হতে পারে)
প্রচণ্ড মাথাব্যথা
অক্ষিকোটরে অর্থাৎ চোখের পেছনে ব্যথা
মাংসপেশি ও অস্থিসন্ধিতে ব্যথা
বমি বমি ভাব
বমি
বিভিন্ন গ্রন্থি ফুলে ওঠা
শরীরে ফুসকুড়ি
ডেঙ্গুতে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হলে তা মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। রোগ মারাত্মক পর্যায়ে চলে গেলে নিচের লক্ষণগুলো দেখা দেয়—
তলপেটে তীব্র যন্ত্রণা
একনাগাড়ে বমি
দ্রুত শ্বাসপ্রশ্বাস
নাক অথবা মাড়ি থেকে রক্ত পড়া
ক্লান্তিতে ভেঙে পড়া
ভীষণ অস্থিরতা
বমি অথবা মলের সঙ্গে রক্ত আসা
ত্বক ঠান্ডা এবং ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া
দুর্বলতা বোধ করা
ডেঙ্গুর চিকিৎসা
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ডেঙ্গু রোগের নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আক্রান্ত ব্যক্তিকে বাড়িতে রেখে বেদনানাশক দিয়ে সারিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়। প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ দিয়ে রোগীর ব্যথা দূর করা হয়। অন্তত একবার আক্রান্ত ব্যক্তি পুনরায় আক্রান্ত হলে তাকে টিকা দেওয়া হয়।
ডেঙ্গু প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণ
ডেঙ্গু রোগের জন্য দায়ী মশা দিনের বেলা কামড়ায়। তাই ডেঙ্গুর ঝুঁকি থেকে নিরাপদ থাকতে চাইলে যা যা করতে হবে—
এমন পোশাক পরতে হবে, যা শরীরের বেশির ভাগ অংশই ঢেকে রাখে
দিনের বেলা ঘুমানোর সময়ে মশারি টানিয়ে ঘুমাতে হবে
জানালায় নেট বা তারজালি ব্যবহার করা যেতে পারে
হাতে-পায়ে মশা প্রতিরোধী ক্রিম বা লোশন ব্যবহার করা যেতে পারে
ঘরে কয়েল বা মশা প্রতিরোধী উদ্বায়ী পদার্থ ব্যবহার করা যেতে পারে
আবাসস্থলের আশপাশে আবদ্ধ পানি অপসারণ করতে হবে
এরপরও কেউ ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হলে যা করবেন—
পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে
প্রচুর পানি বা তরল খাবার খেতে হবে
ব্যথা কমাতে প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ দিতে হবে
আইবুপ্রোফেন এবং অ্যাসপিরিনের মতো নন-স্টেরয়ডাল ওষুধ সেবন থেকে বিরত থাকতে হবে
অন্যান্য সব লক্ষণের দিকে খেয়াল রাখতে হবে এবং জটিলতা দেখা দিলে দ্রুত অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
তথ্যসূত্র: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা