একসময় একশ্রেণির অসাধু লোক নানা কৌশলে দাঁত থেকে দৃশ্যমান পোকা বের করে আনতেন। পথেঘাটে বাজারে দাঁতের পোকা বের করার জন্য বসতেন হাতুড়ে চিকিৎসকেরা। এখনো প্রায়ই শোনা যায়—দাঁতে পোকা ধরেছে। আসলেই কি দাঁতে পোকা ধরে?
দাঁতের গর্ত, দাঁতের পোকা
সাধারণত দাঁতের গর্তকে দাঁতের পোকা ধরা বলে চালানো হয়। আমরা যদি ২৪ ঘণ্টায় একবারও সঠিক নিয়মে দাঁত পরিষ্কার না করি, তবে নিঃসৃত লালার একটি বিশেষ উপাদান দাঁতের পৃষ্ঠে আঠালভাবে লাগতে শুরু করে। সাধারণভাবে মুখের মধ্যে অসংখ্য সুপ্ত এককোষীয় জীবাণুর বসবাস, তাদের মধ্যে বিশেষ কিছু ব্যাকটেরিয়া সেখানে বাসা বাঁধে ও দ্রুত বংশবিস্তার করা শুরু করে। এসব জীবাণু খালি চোখে দেখা সম্ভব নয়।
দাঁতের পৃষ্ঠে জমা হওয়া এসব ব্যাকটেরিয়া যখন মিষ্টিজাতীয় খাবার যেমন চিনির তৈরি খাবার বা চকলেট, এমনকি আলুর চিপস পায়, তখন একে কাজে লাগিয়ে বিশেষ প্রক্রিয়ায় অ্যাসিড তৈরি করে। এই অ্যাসিড দাঁতের শক্ত প্রতিরক্ষা আবরণ ক্ষয় করে ডেন্টাল ক্যারিজ বা গর্ত সৃষ্টি করে।
দাঁতের গর্ত থেকে জটিলতা
একবার গর্ত হয়ে গেলে পরে ভালোভাবে ব্রাশ করে বা ওষুধ সেবনের মাধ্যমেও ঠিক করা যায় না। যত দ্রুত সম্ভব দন্তচিকিৎসকের পরামর্শে ফিলিং (গর্ত ভরাট) নামক চিকিৎসার মাধ্যমে দাঁতকে সুস্থ করা যায়। এটি অতি সাধারণ চিকিৎসা, খরচও স্বল্প। কিন্তু প্রাথমিক পর্যায়ের গর্ত তেমন কোনো সমস্যা করে না বলে অনেকেই একে অবহেলা করে। পরে দাঁতের ভেতরের মজ্জা সংক্রমিত হয়ে তীব্র ব্যথার সৃষ্টি করে। তখন রুট ক্যানেল নামক জটিল, সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে।
অনেকে আবার ব্যথা কমানোর জন্য চিকিৎসা ছাড়াই ফার্মাসি থেকে নানা ওষুধ সেবন করে নানা জটিলতার সৃষ্টি করে। গর্ত থেকে সংক্রমণ দাঁতের গোড়ায় বা হাড়ের মধ্যে ছড়িয়ে গ্রানুলোমা, পুঁজ, সিস্ট, সেলুলাইটিসসহ নানা জটিলতা সৃষ্টির আশঙ্কা থাকে। ভাঙা দাঁতের অমসৃণ অংশ জিহ্বা বা চোয়ালে ক্ষত তৈরি করে। দীর্ঘসময় এই ক্ষত রয়ে গেলে ক্যানসারের মতো ভয়াবহ সমস্যাও হতে পারে। অতিরিক্ত অবহেলায় দাঁতটির ধারক কলা নষ্ট হয়ে দাঁত হারাতে হয়।
করণীয়
দাঁতে গর্ত যেন না হয়, প্রথমে সেই চেষ্টা করতে হবে। সে জন্য সকালে নাশতার পর ও রাতে খাবার শেষে দুই মিনিট ধরে ফ্লোরাইড যুক্ত টুথপেস্ট ও নরম টুথব্রাশ দিয়ে দাঁতের মোট পাঁচটি পৃষ্ঠ পরিষ্কার করতে হবে। দাঁতের ফাঁকে খাবার ঢুকলে ডেন্টাল ফ্লস ব্যবহার করা জরুরি। যাঁদের মুখ শুষ্ক থাকে বা অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, শ্বাসকষ্ট, বিষণ্নতা, ক্যানসার, উচ্চরক্তচাপ রয়েছে, তাঁরা চিকিৎসকের পরামর্শে মাউথওয়াশ ব্যবহার করতে পারে। অসম বা উঁচুনিচু ফাঁকা দাঁত পরিষ্কারের সঠিক পদ্ধতি জানতে হবে।
মিষ্টিজাতীয় খাদ্যের পরিবর্তে মৌসুমি ফলমূল, শাকসবজি, ছোট মাছ, সামুদ্রিক মাছ, টকদইজাতীয় খাবার খেতে হবে। ভিটামিন সি ও ক্যালসিয়াম যুক্ত খাবার দাঁতের স্বাস্থ্য ভালো রাখে। জরুরি বিষয় হচ্ছে, ব্যথা হোক বা না হোক, বছরে অন্তত একবার বৈধ দন্তচিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
কোনো অবৈজ্ঞানিক বা কুসংস্কারে বিশ্বাসী হয়ে বা অসাধু হাতুড়ে ডাক্তারের খপ্পরে অপচিকিৎসায় অতি মূল্যবান দাঁত হারানো যাবে না। দাঁতে পোকা বলে কিছু নেই। পোকা বের করার গল্পও তাই ধোঁকাবাজি বই কিছু নয়।
ডা. মো. আসাফুজ্জোহা: দন্তবিশেষজ্ঞ, কলাবাগান রাজ ডেন্টাল সেন্টার