মেনোপজের পর মন কীভাবে বদলে যায়?
আমার ৪৫ বছর বয়সী মা ইদানীং প্রায়ই অনেক বিষয় ভুলে যান, ক্লান্ত বোধ করেন। ডাক্তারের নির্ধারিত ঘুমের ওষুধ ছাড়া রাতে ঘুমাতে পারেন না। আর অহেতুক দুশ্চিন্তা করেন। দুশ্চিন্তার প্রভাব এতই বেশি যে হঠাৎ করে তাঁর বুক ধড়ফড় করা শুরু করে। মেজাজও খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে। তবে বিশেষ কোনো রোগ ধরা পড়ে না। ডাক্তারের পরামর্শ থাকে, ‘এই বয়সে একটু এমন হয়েই থাকে। স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন করুন।’
এই বয়সে শুধু আমার মা নন, সব মা-ই কমবেশি এই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যান। নানা কারণে মধ্যবয়সে দাঁড়িয়ে এ রকম শারীরিক ও মানসিক জটিলতা শুরু হয়। তবে আমি নির্দিষ্ট করে বলতে চাচ্ছি, নারীর জীবনচক্রের একটা অংশ মেনোপজের কথা।
কৈশোরে বয়ঃসন্ধিকালে মাসিকের মধ্য দিয়ে নারীর প্রজননচক্র শুরু হয়। আর মধ্যবয়সে এসে এ চক্র বন্ধ হয়, যাকে বলে মেনোপজ। সাধারণত টানা ১২ মাস কারও মাসিক বন্ধ থাকলে বলা চলে তাঁর মেনোপজ হয়েছে; অর্থাৎ মাসিক পুরোপুরি বন্ধ হয়েছে। নারীজীবনের এই সময় সাধারণত ৪৫-৫৫ বছরের মধ্যে হয়ে থাকে। এ সময় একজন নারী তাঁর কৈশোরের মাসিক শুরুর সময়ের মতোই অনেক শারীরিক-মানসিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যান। অনেক সমস্যার সম্মুখীন হন। শারীরিক পরিবর্তনের মধ্যে রয়েছে অনিয়মিত মাসিক বা মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়া, যোনিপথ শুষ্ক থাকা, অতিরিক্ত গরম লাগা (হট ফ্ল্যাশ), ওজন বেড়ে যাওয়া, চুল পাতলা হয়ে যাওয়া, স্তন ছোট হয়ে যাওয়া ইত্যাদি। শারীরিক এসব পরিবর্তনের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যেরও অনেক পরিবর্তন ঘটে।
মেনোপজে নারীর মানসিক স্বাস্থ্যের পরিবর্তন
গুরুত্ব হারিয়ে ফেলার আশঙ্কা থেকে বিষণ্নতা
আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীর যৌবনকে, সন্তান জন্মদানকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ করা হয়েছে। আর এই সমাজব্যবস্থায় থেকে নারী যখন তাঁর ‘যৌবন’ হারান, শারীরিক পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যান, তখন তিনি গুরুত্ব হারিয়ে ফেলার আশঙ্কায় হতাশায় ভোগেন। মন খারাপ করেন। ধীরে ধীরে যা বিষণ্নতায় রূপ নেয়। তা ছাড়া এই বয়সে সন্তানদের বড় হওয়া, তাঁকে ছেড়ে সন্তানের দূরে চলে যাওয়া, সন্তানদের নতুন পরিবার গঠন, ক্যারিয়ারের পরিবর্তন বা অবসর—সব মিলিয়ে একজন নারী বিষণ্নতায় আক্রান্ত হতে পারেন। এই সময়ে বিষণ্নতার ঘটনা দ্বিগুণ হয়।
বুক ধড়ফড়, শ্বাসকষ্ট
এই সময়ে নারীদের আকস্মিক উদ্বেগের অনুভূতি হয়। সঙ্গে ঘাম, কাঁপুনি, শ্বাসকষ্ট হয়, বুক ধড়ফড় করে। অনেকে এটিকে ‘হট ফ্ল্যাশ’ ভেবে থাকেন। আদতে হট ফ্ল্যাশ আর অতিরিক্ত উদ্বেগের মধ্যে মিল থাকলেও উদ্বেগের ক্ষেত্রে বুক ধড়ফড় ও শ্বাসকষ্ট হয়। যেটা হট ফ্ল্যাশে হয় না।
মনোযোগ ধরে রাখতে না পারা, ভুলে যাওয়া
মেনোপজে অসংখ্য শারীরিক, মানসিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হয় একজন নারীকে। এত কিছু সামলে তাঁর নিজের প্রতি যত্ন নেওয়া হয়ে ওঠে না। ফলে কোনো কাজে তিনি ঠিকঠাক মনোযোগও দিতে পারেন না। মনোযোগের অভাবে ছোট-বড় অনেক বিষয়ই তিনি ভুলে বসেন। তা ছাড়া সময়ের সঙ্গে মস্তিষ্কের কার্যকারিতাও কমতে থাকে।
মুড সুইং, কান্নাকাটি, অনিশ্চয়তা
এই সময়ে নারীরা অনেক মুড সুইংয়ের মধ্য দিয়ে যান। এর পেছনে রয়েছে ইস্ট্রোজেন হরমোনের ভূমিকা। এই হরমোন কমে যাওয়ার ফলে ও আয়রনের অভাব থেকে মুড সুইং হয়ে থাকে। অনেক সময় আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে তাঁরা কান্নাকাটি করেন, অনিশ্চয়তায় ভোগেন।
রাতের ঘুম নষ্ট
অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা ও বিষণ্নতার জন্য ইনসমনিয়া হতে পারে। রাতে ঘুম আসে না, ফলে মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায় ও কাজে অনীহা সৃষ্টি হয়। ইনসমনিয়ার জন্য অনেকে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই ঘুমের ওষুধ কিনে খেয়ে থাকেন, যা শরীরের জন্য নিয়ে আসতে পারে ক্ষতিকর প্রভাব।
মেনোপজ মানে কিছুই শেষ নয়, নয় গুরুত্বহীন হয়ে যাওয়া। নারীর জীবনে মাসিকের শুরু, মাসিকের শেষ—এটি অতি সাধারণ একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। একটা সময় পর্যন্ত মাসিকের শুরুটা মেনে নেওয়া একজন কিশোরীর জন্য খুব কঠিন কাজ থাকে। কিন্তু পরে সে মেনে নেয়, মানিয়ে নেয়, নারীত্বকে উপভোগ করতে শিখে যায়। তেমনই এই নারীজীবনের আরেকটি অংশ হচ্ছে মেনোপজ, যা মাসিক শুরুর মতোই একটি পরিবর্তন। তাই একে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, আপনি শুধু একা নন, এই পৃথিবীর সব নারীকেই এর মধ্য দিয়ে যেতে হয়৷
এই বয়সী নারী কমবেশি আমাদের সবার পরিবারেই আছেন। তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি আমাদের বিশেষ করে মনোযোগী হতে হবে। তাঁদের কোনো কথায় বা আচরণে কষ্ট না পেয়ে সেটাকে স্বাভাবিকভাবে নিতে হবে। তাঁর সঙ্গে সহজ সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। সংসারের কিছু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব তাঁকে দিতে হবে। তিনি যেন নিজেকে গুরুত্বহীন না ভাবেন, সেটি খেয়াল রাখতে হবে।