তামিম ইকবালের জীবন রক্ষা করেছে সিপিআর, এটি কেন সবার জেনে রাখা জরুরি, কোথায় শিখবেন
সিপিআর বা কার্ডিওপালমোনারি রিসাসিটেশন জীবন রক্ষাকারী এক কৌশল। এটি সাধারণত কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট বা হার্ট অ্যাটাক হলে জীবন রক্ষা করে। বাড়িতে, কর্মক্ষেত্রে, হাসপাতালে, রাস্তাঘাটে চলার পথে আপাতদৃষ্টে সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষের যেকোনো সময়ে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হতে পারে। হঠাৎ এ রকম অসুস্থ হয়ে পড়ার সময় থেকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত এই সংকটাপন্ন সময়টায় কারও জীবন বাঁচানোর জন্য সিপিআর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ২৪ মার্চ জনপ্রিয় ক্রিকেট তারকা তামিম ইকবাল হার্ট অ্যাটাক করেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে সিপিআর দেওয়া হয়েছিল বলেই দ্রুততম সময়ে চিকিৎসকেরা তাঁকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিতে পেরেছেন।
সিপিআর কখন এবং কাদের দিতে হবে
যদি কারও কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয় অর্থাৎ আচমকা সংজ্ঞা হারানো কোনো ব্যক্তির যখন হৃদ্যন্ত্র সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গিয়ে ক্যারোটিড পালস না থাকে, তখনই দ্রুত সিপিআর শুরু করতে হবে। এ সময়ে আক্রান্ত ব্যক্তি শ্বাস না–ও নিতে পারেন বা শ্বাস-প্রশ্বাস অস্বাভাবিক হতে পারে। অনেক কারণেই কোনো ব্যক্তি অজ্ঞান হতে পারেন। তবে শুধু ক্যারোটিড পালস না থাকলেই বুঝতে হবে আক্রান্ত ব্যক্তির কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছে।
সিপিআরের ধাপ
প্রথমেই নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
আক্রান্ত ব্যক্তিকে জোরে জোরে ডাকতে হবে, কোনো সাড়া দেন কি না বোঝার জন্য।
ক্যারোটিড পালস অনুভব করার চেষ্টা করতে হবে।
শ্বাস নিচ্ছেন কি না, তা বোঝার চেষ্টা করতে হবে। যদি আক্রান্ত ব্যক্তি সাড়া না দেন এবং ক্যারোটিড পালস না থাকে, তাহলে সিপিআর শুরু করতে হবে।
চিত হয়ে শুয়ে থাকা কোনো মানুষের গলায় উঁচু হয়ে থাকা হাড় থেকে বাঁয়ে বা ডানে স্লাইড করে এলে যে ধমনি আঙুলে অনুভব করা যায়, সেটিই ক্যারোটিড পালস। তবে একই সঙ্গে অবিলম্বে জরুরি সেবাকেন্দ্রে ফোন করে সাহায্য চাইতে হবে। এর জন্য সর্বোচ্চ ১০ সেকেন্ড সময় ব্যয় করা যাবে।
যেভাবে সিপিআর দিতে হবে
দুই হাতের তালু এক করে বুকের মাঝের অংশে রেখে বুকে চাপ বা চেস্ট কম্প্রেশন শুরু করতে হবে। প্রতি মিনিটে ১০০–১২০ বার হিসাবে দিতে হবে।
চাপ দেওয়ার গভীরতা হবে প্রায় ৫ থেকে ৬ সেন্টিমিটার বা ২ ইঞ্চি।
বুকে প্রতি ৩০টি চাপ দেওয়ার পর দুইবার কৃত্রিম শ্বাস দিতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তির নাক বন্ধ করে মুখের মাধ্যমে শ্বাস দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে নিশ্চিত করতে হবে যে বুক ওপরে উঠছে।
শিশুদের ক্ষেত্রে ১৫: ২ পদ্ধতি মানতে হয়। একেবারে ছোট শিশুর বুকে চাপ দেওয়ার সময় দুই আঙুল ব্যবহার করা হয় এবং মুখ-নাক ঢেকে শ্বাস দেওয়া হয়। দুই মিনিট পরপর ক্যারোটিড পালস চেক করতে হবে।
অনেক অ্যাম্বুলেন্সে অটোমেটেড এক্সটার্নাল ডিফিব্রিলেটরের (এইডি) ব্যবস্থা থাকে। যদি থাকে, তাহলে দ্রুত সেটা বুকে লাগাতে হবে। এটি হৃৎপিণ্ডের স্বাভাবিক ছন্দ ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে। এইডি ব্যবহার করার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলি অনুসরণ করতে হবে। আমাদের দেশে বিমানবন্দর, কিছু বড় বড় হোটেল ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় এইডির ব্যবস্থা আছে।
যতক্ষণ পর্যন্ত ব্যক্তির স্বতঃস্ফূর্ত সঞ্চালন ফিরে না আসে, অর্থাৎ ক্যারোটিড পালস সচল না হয় বা চিকিৎসক এসে মৃত ঘোষণা না করেন, ততক্ষণ পর্যন্ত সিপিআর চালিয়ে যেতে হবে।
সঠিক সময়ে এবং সঠিকভাবে সিপিআর প্রয়োগ করলে এটি মানুষের জীবন বাঁচাতে সাহায্য করে। সিপিআরের মাধ্যমে চিকিৎসার সময় বাড়ানো যায় ও মস্তিষ্কের ক্ষতি প্রতিরোধ করা যায়। জীবনরক্ষাকারী এই সহজ কৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল–কলেজ শিক্ষাক্রমে থাকা উচিত। সিপিআর প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য প্রশিক্ষিত জনবল বর্তমানে তৈরি হয়েছে, তাঁদের ব্যাপকভাবে কাজে লাগানো দরকার।
কোথায় শিখবেন
চিকিৎসক, নার্স, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের তো বটেই, সাধারণ মানুষেরও সিপিআর প্রশিক্ষণ নেওয়া উচিত। উন্নত দেশে স্কুল–কলেজের শিক্ষাক্রমেও সিপিআর অন্তর্ভুক্ত আছে। বাংলাদেশে বারডেম জেনারেল হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিন বিভাগে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন বেসিক লাইফ সাপোর্ট (বিএলএস) ও অ্যাডভান্স কার্ডিয়াক লাইফ সাপোর্ট (এসিএলএস) নামে সিপিআর প্রশিক্ষণ চালু আছে। এ ছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ অনেক সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে এই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। অপ্রশিক্ষিত কোনো ব্যক্তি কোনোভাবেই সঠিকভাবে সিপিআর দিতে পারেন না। চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যসেবাদানকারী ছাড়া সাধারণ মানুষের জন্য বেসিক লাইফ সাপোর্ট বা বিএলএস প্রশিক্ষণই যথেষ্ট। অ্যাডভান্সড কার্ডিয়াক লাইফ সাপোর্ট সাধারণত স্বাস্থ্যসেবাদানকারীরা দিয়ে থাকেন।
ডা. মধুরিমা সাহা, সহকারী অধ্যাপক, ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিন, বারডেম হাসপাতাল, ঢাকা