আজকাল নারীর শরীরে ম্যাগনেশিয়ামের এত ঘাটতি কেন, এর পরিণতি কী
আমাদের শরীরের জন্য যেসব খনিজ উপাদান খুব দরকারি, সেসবের মধ্যে ম্যাগনেশিয়াম অন্যতম। এটি শরীরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। শরীরের স্বাভাবিক ছন্দের জন্য দরকারি তো বটেই, নারীদের ভালো থাকার জন্য ম্যাগনেশিয়াম অতি প্রয়োজনীয় এক উপাদান। ম্যাগনেশিয়াম নারীর হরমোন নিয়ন্ত্রণ, হাড়ের ঘনত্ব ও হৃৎপিণ্ড থেকে রক্ত পরিবহনে (কার্ডিওভাসকুলার) ভূমিকা রাখে। এর অভাবে মাংসপেশিতে টান, উদ্বেগ, হৃদ্রোগসহ নানা সমস্যা দেখা দেয়। কম ম্যাগনেশিয়ামযুক্ত আধুনিক খাবারদাবারের সঙ্গে খুব বেশি মানসিক চাপ যুক্ত হলে নারীদের শরীরে সৃষ্টি হয় জটিল সব সমস্যা। উল্টো দিকে ম্যাগনেশিয়ামসমৃদ্ধ খাবার গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপ ও কিডনিজনিত রোগ প্রি–একলাম্পসিয়ার মতো সমস্যাসহ নানা জটিলতা নিরসনে সাহায্য করে।
গবেষণা কী বলে
‘ফ্রন্টিয়ার্স ইন নিউট্রিশন’ জার্নালে গত আগস্ট মাসে প্রকাশিত গবেষণাপত্র থেকে জানা যায়, নারীদের প্রজননতন্ত্রের প্রদাহজনিত (পেলভিক ইনফ্ল্যামেটরি) রোগের সঙ্গে কম ম্যাগনেশিয়ামযুক্ত খাদ্য গ্রহণের সম্পর্ক আছে।
২০২৩ সালে ‘হেলথ সায়েন্স রিপোর্ট’ জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে গবেষকেরা দেখিয়েছেন, নারীর শরীরে পুরুষ হরমোনের আধিক্যজনিত পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম রোগের ক্ষেত্রে ম্যাগনেশিয়াম সাপ্লিমেন্ট উপকার করে।
একই বছর ‘স্প্রিংগার লিংক’ জার্নালে প্রকাশিত আরেকটি গবেষণাপত্রে জানা গেছে, পুরুষ ও নারী উভয়েরই মস্তিষ্কের আকারের সঙ্গে ম্যাগনেশিয়ামসমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণের সম্পর্ক আছে। অর্থাৎ ম্যাগনেশিয়ামসমৃদ্ধ খাবার বেশি খেলে মস্তিষ্কের আকার বড় হয়।
ম্যাগনেশিয়াম কী উপকার করে
ম্যাগনেশিয়াম আমাদের শরীরের ৩০০টির বেশি জৈব রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সহায়তা করে আমাদের শরীরের সব এনজাইমের কাজে, অর্থাৎ ম্যাগনেশিয়াম দেহের শক্তি উৎপাদনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। এটি খাবারকে শক্তিতে পরিণত করতে সাহায্য করে।
বলা হয়, ম্যাগনেশিয়াম নামক ‘মুদ্রা’ খরচের মাধ্যমে আমাদের শরীর শক্তি ‘কেনে’। পকেটে টাকা না থাকলে যেমন কিছুই চলে না, দেহে ম্যাগনেশিয়ামের ঘাটতি হলেও একই ঘটনা ঘটে।
ম্যাগনেশিয়ামের ঘাটতি নারীর শরীরকে ঘুণপোকার মতো গোপনে শেষ করে দেয়। একজন পূর্ণবয়স্ক নারীর শরীর ঠিকভাবে চলার জন্য দিনে কমপক্ষে ৩৫০ মিলিগ্রাম ম্যাগনেশিয়ামের দরকার। এই খনিজ উপাদানের ৫০ শতাংশই দরকার হয় হাড় ঠিক রাখতে। শরীরে ম্যাগনেশিয়ামের ঘাটতি দেখা দিলে তা প্রথমেই হাড়কে ক্ষতিগ্রস্ত করে। গর্ভাবস্থায় ও দুগ্ধদানকালে নারীদের আরও বেশি ম্যাগনেশিয়ামের দরকার হয়।
নারীদের জন্য ম্যাগনেশিয়াম এত দরকারি কেন?
নারী স্বাস্থ্যের প্রায় সব ক্ষেত্রেই এই পুষ্টি উপাদান কাজে লাগে। এটি হরমোন নিয়ন্ত্রণ থেকে হাড় ঠিক রাখতে কাজ করে। এটি নারীর জীবনচক্রের প্রতিটি অধ্যায়—মাসিক, গর্ভাবস্থা ও রজঃচক্রের নিবৃত্তি বা মেনোপজে প্রভাব রাখে।
ম্যাগনেশিয়ামের প্রধান সুবিধা হলো এটি নারীর শরীরে হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখে। আর এটা তো জানেন, মাসিকের সময় নারীর শরীরে হরমোনের তারতম্য দেখা দেয়।
বেশির ভাগ নারীই বলেন, মাসিকের সময় তাঁদের ঘন ঘন মেজাজ পরিবর্তন (মুড সুইং), পেটে গ্যাস জমা, পেশিতে টানসহ নানা সমস্যা দেখা দেয়। এসব ঘটে মূলত শরীরে এস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন নামের দুটি হরমোনের তারতম্যের কারণে। ম্যাগনেশিয়াম এসব হরমোন নিয়ন্ত্রণ করে।
গবেষকেরা বলেছেন, বিশেষ করে ভিটমিন বি৬–এর সঙ্গে ম্যাগনেশিয়াম সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করলে, সেটি বিরক্তি, উদ্বেগ ও শারীরিক অস্বস্তি অনেকটাই কমিয়ে দেয়।
অনেক নারীই মেনোপজ নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভোগেন। নারী যখন মেনোপজের দিকে যান, তখন তাঁদের হাড় ও অস্থি নরম (অস্টিওপরোসিস) হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। এ সময় ম্যাগনেশিয়াম পর্যাপ্ত ক্যালসিয়াম গ্রহণে সাহায্য করে হাড়ের সুস্থতা রক্ষা করে। ম্যাগনেশিয়াম তখন ক্যালসিয়াম হজমে সাহায্য করে এবং হাড়ের ঘনত্ব বজায় রাখে। পরবর্তী সময়ে হাড়ের ফাটল থেকেও নারীদের বাঁচায়।
ম্যাগনেশিয়াম সঠিকভাবে পেশির সংকোচন ও প্রসারণে ভূমিকা রাখে। বিশেষ করে গর্ভাশয়ের পেশির কার্যক্রমে এর ভূমিকা খুব দরকারি। এটি পেশির কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অপরিণত সন্তান জন্ম দেওয়া রোধ করে। গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপ ও প্রি–একলাম্পসিয়াসহ নানা জটিলতা কমায়।
ম্যাগনেশিয়াম গর্ভের ভ্রূণের স্নায়ুতন্ত্র গঠনে সাহায্য করে এবং ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করে রক্তে শর্করার মাত্রা ঠিক রাখে। অর্থাৎ এটি অন্তঃসত্ত্বা নারী ও শিশুর জন্য খুবই জরুরি।
ম্যাগনেশিয়ামকে বলা হয় ‘স্বস্তিদায়ক খনিজ’। কারণ, এটি স্নায়ু ঠান্ডা করে। স্নায়ুর ভেতরে সংকেত বহনকারী সেরোটোনিন ও গামা অ্যামিনোবিউট্রিক অ্যাসিডের মতো নিউরোট্রান্সমিটারগুলোকে চালু রাখে। আর এসব নিয়ন্ত্রণ করে মেজাজমর্জি। ম্যাগনেশিয়াম স্নায়ুকে স্বাভাবিক রাখে ও মেলাটোনিন হরমোন নিয়ন্ত্রণ করে। এই মেলাটোনিন পালন করে আমাদের মাসি-পিসির ভূমিকা, অর্থাৎ চোখে ঘুম আনে এবং উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দূর করে।
কার্ডিওভাসকুলারজনিত রোগ নিয়ন্ত্রণে ম্যাগনেশিয়াম খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিশেষ করে মেনোপজের পর যখন নারীর হৃদ্রোগের ঝুঁকি বাড়ে, তখন এটি খুব কাজে দেয়। এটি ধমনিতে ব্লক তৈরি হওয়ার ঝুঁকি কমায়। রক্তচাপ স্বাভাবিক ও হৃৎস্পন্দনের গতি ঠিক রাখে।
গবেষকেরা প্রমাণ করেছেন, ম্যাগনেশিয়াম নারীর উচ্চ রক্তচাপ কমায় এবং হৃৎপিণ্ড ভালো রাখে, বিশেষ করে যখন ৫০ বছরের বেশি বয়সী নারীদের হৃদ্রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
আজকাল নারীদের ম্যাগনেশিয়ামের ঘাটতি হয় কেন?
আজকাল নারীদের শরীরে প্রায়ই ম্যাগনেশিয়ামের ঘাটতির কথা শোনা যায়। কথিত ‘আধুনিক জীবনযাপন’ এর বড় কারণ। প্রথমত, আজকাল অনেকেই বাজারের প্রক্রিয়াজাত খাবার খেতে পছন্দ করেন। এসব খাবারে ম্যাগনেশিয়ামসহ বেশির ভাগ প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান থাকে না।
দ্বিতীয়ত, ম্যাগনেশিয়ামসমৃদ্ধ সবুজ শাকসবজি, বীজ ও বাদামজাতীয় খাবারের জায়গা দখল করে নিচ্ছে উচ্চ শর্করাসমৃদ্ধ ও অস্বাস্থ্যকর চর্বিজাতীয় খাবারদাবার।
এখনকার জীবনযাপনের অতিরিক্ত মানসিক চাপ শরীরের ম্যাগনেশিয়ামের চাহিদা বাড়ায়। অতিরিক্ত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা শরীরের ম্যাগনেশিয়াম সরবরাহ নষ্ট করে দিতে পারে।
মাসিক, গর্ভাবস্থা ও মেনোপজ বা রজঃনিবৃত্তির সময় নারীর শরীরে অতিরিক্ত ম্যাগনেশিয়াম দরকার পড়ে। তখন পর্যাপ্ত ম্যাগনেশিয়ামসমৃদ্ধ খাবার না খেলে শরীরে এর ঘাটতি দেখা দেয়। এ ছাড়া পাকস্থলীর গন্ডগোলের কারণেও অনেক সময় শরীর ম্যাগনেশিয়াম শোষণ করতে পারে না।
ম্যাগনেশিয়ামের ঘাটতি কীভাবে বুঝবেন?
ম্যাগনেশিয়ামের ঘাটতির কারণে শরীরের বিভিন্ন জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় গন্ডগোল দেখা দেয়। এর অভাবে সাধারণত পেশিতে টান, খিঁচুনি ও শারীরিক অস্বস্তি তৈরি হয়।
ম্যাগনেশিয়াম তিন শতাধিক জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত। এর অভাবে পেশির সংকোচন ও প্রসারণ কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়। যখন শরীরে এর অভাব দেখা দেয়, তখন পেশি সঠিকভাবে সংকুচিত ও শিথিল হতে পারে না। এ কারণে পেশিতে যন্ত্রণা ও ব্যথা হয়।
স্নায়ুতন্ত্রের গন্ডগোলও মূলত ম্যাগনেশিয়ামের ঘাটতির কারণে হয়। এর অভাবে সাধারণত মেজাজ খিটখিটে, অবসাদ ও উদ্বেগ দেখা দেয়। এর অভাবে উচ্চ রক্তচাপ দেখা দেয় ও ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। ফলে শরীর পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে পারে না এবং নতুন উদ্যমে কাজ করা হয়ে ওঠে কঠিন। গুরুতর ক্ষেত্রে ম্যাগনেশিয়ামের ঘাটতির কারণে স্নায়ুর সমস্যাও দেখা দেয়। তখন হাত-পা অসাড় হয়ে যায়, ঝিমঝিম করে, এমনকি মৃগী রোগও দেখা দিতে পারে।
কার্ডিওভাসকুলার রোগের ক্ষেত্রে ম্যাগনেশিয়ামের অভাবে হৃৎস্পন্দনের ছন্দপতন, উচ্চ রক্তচাপসহ হৃদ্রোগের উচ্চ ঝুঁকি তৈরি করে। হৃদ্যন্ত্রের স্বাভাবিক স্পন্দন ঠিক রাখার জন্যও ম্যাগনেশিয়াম খুব দরকারি।
ম্যাগনেশিয়ামের ঘাটতির কারণে শরীর ঠিকভাবে ক্যালসিয়াম শোষণ করতে পারে না। ফলে অস্থি ও হাড় দুর্বল হয়ে পড়ে। এ কারণে অস্থি নরম হয়ে অস্টিওপরোসিস রোগ দেখা দিতে পারে। ম্যাগনেশিয়ামের অভাবে রক্তে শর্করার মাত্রা ঠিক থাকে না। এ কারণে এটি শরীরে ইনসুলিন উৎপাদন কমিয়ে দিয়ে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়।
ম্যাগনেশিয়ামের ঘাটতিতে কি মৃত্যু হয়?
ম্যাগনেশিয়ামের ঘাটতি সাধারণত মৃত্যুঝুঁকি তৈরি করে না। তবে শরীরে এর ব্যাপক সংকট অনেক সময় মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়। ম্যাগনেশিয়ামের অভাবে পেশির টান, খিঁচুনি, হৃদ্রোগসহ স্নায়ুর নানা জটিলতা দেখা দেয়। এসব রোগ সঠিক সময়ে নির্ণয় করে চিকিৎসা না করালে মৃত্যুর ঝুঁকি তৈরি করে। বিশেষ করে যাঁরা পাকস্থলীর পীড়া, মদ্যপানজনিত রোগসহ দীর্ঘদিন অপুষ্টিতে ভুগছেন, তাঁদের ম্যাগনেশিয়ামের ঘাটতির বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
ম্যাগনেশিয়ামের প্রাকৃতিক উৎস
অনেক খাবারই প্রাকৃতিকভাবে ম্যাগনেশিয়ামসমৃদ্ধ। পাতাযুক্ত বিভিন্ন শাকসবজি, যেমন পালংশাক, মেথি পাতা ও লালশাক ম্যাগনেশিয়ামের ভালো উৎস।
বিভিন্ন ধরনের ডাল, যেমন মুগ, ছোলা উচ্চমাত্রার ম্যাগনেশিয়ামসমৃদ্ধ। খাবারে যেকোনোভাবে ডাল থাকা ম্যাগনেশিয়ামের ঘাটতি সহজে পূরণ করে।
কাজু বাদাম, চিনাবাদাম ও কুমড়ার বিচি ম্যাগনেশিয়ামে ভর্তি। দিনের খাবারের ওপর এগুলো ছড়িয়ে দিলে আপনার খাবারকে যেমন তা কুড়মুড়ে করবে, তেমন ম্যাগনেশিয়ামের জোগানও দেবে। বাদামি চাল ও ভুট্টাতে ম্যাগনেশিয়াম পাবেন।
ম্যাগনেশিয়াম সাপ্লিমেন্ট গ্রহণে সাবধানতা
ম্যাগনেশিয়ামের সাপ্লিমেন্ট নেওয়ার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। কারণ, অতিরিক্ত ম্যাগনেশিয়াম পেটের সমস্যা, যেমন ডায়রিয়া, বমি ভাব ও পেশি সংকোচনের মতো জটিলতা তৈরি করতে পারে।
যাঁদের কিডনির সমস্যা আছে, তাঁদেরও এ সাপ্লিমেন্ট নেওয়ায় সতর্ক থাকতে হবে। কারণ, অতিরিক্ত ম্যাগনেশিয়াম গ্রহণের ফলে কিডনির জটিলতা তৈরি হতে পারে। কিছু ওষুধ, যেমন অ্যান্টিবায়োটিক ও রক্তচাপের ওষুধের সঙ্গেও ম্যাগনেশিয়ামের নেতিবাচক সম্পর্ক আছে। তাই এসব ওষুধ চলা অবস্থায় ম্যাগনেশিয়াম গ্রহণ করতে চাইলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
হজম শক্তি ঠিক রাখতে চাইলে উচ্চমাত্রার ক্যালসিয়াম ও আয়রনের সঙ্গে ম্যাগনেশিয়াম গ্রহণ করা যাবে না। ম্যাগনেশিয়াম গ্রহণকালে প্রচুর পানি খেতে হবে।
সর্বোপরি ম্যাগনেশিয়ামের ঘাটতি তো পূরণ করতে হবেই। তবে সাপ্লিমেন্ট হিসেবে কত মাত্রায় নিতে হবে, সে জন্য অবশ্যই চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে নিন।
সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া