যেসব কারণে কোনো ব্যক্তির কার্যক্ষমতা ও কার্যকাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তার মধ্যে প্রধান কারণ হচ্ছে এই ‘মাথাব্যথা’। স্নায়ুরোগের মধ্যেও মাথাব্যথার হার সবচেয়ে বেশি। বারবার মাথাব্যথার কারণে ভুক্তভোগীরা পারিবারিক, সামাজিক, আর্থিক ও পেশাগত জীবনে ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
বিশ্বব্যাপী মোট অ্যাডাল্ট (১৮-৬০ বছর) জনসংখ্যার প্রায় ৪৬ ভাগ প্রতিবছর মাথাব্যথায় একবার না একবার আক্রান্ত হয়। এই মাথাব্যথার রোগীদের মধ্যে শতকরা প্রায় ১১ জন ‘মাইগ্রেন’ বা আধকপালি মাথাব্যথা, ৭০ জন ‘টেনশন টাইপ হেডেক’ বা মাংসপেশির সংকোচনজনিত মাথাব্যথা এবং শতকরা প্রায় ৩ জন রোগী ‘ক্রনিক ডেইলি হেডেক’ বা দীর্ঘস্থায়ী মাথাব্যথায় আক্রান্ত হন। সাধারণত বয়স্ক নারীরাই বিভিন্ন ধরনের মাথাব্যথায় কষ্ট পান। প্রতিবছর শতকরা প্রায় ২০ জন শিশু ও কিশোর মাথাব্যথায় আক্রান্ত হয়।
মাথাব্যথার প্রকারভেদ
মাথাব্যথা প্রধানত দুই প্রকার।
১. প্রাইমারি হেডেক, যেমন মাইগ্রেন, টেনশন টাইপ হেডেক, ক্লাস্টার হেডেক ইত্যাদি।
২. সেকেন্ডারি হেডেক, যেমন সাইনোসাইটিস, মাসটয়ডাইটিস, গ্লুকোমার স্ট্রোক, মাথার আঘাতজনিত, মস্তিষ্কের টিউমার ইত্যাদি।
মাইগ্রেন
প্রায় ১১ ভাগ বয়স্ক মানুষের এই ধরনের মাথাব্যথা হয়। পুরুষের তুলনায় নারীদের মধ্যে মাইগ্রেন বেশি দেখা যায়। সাধারণত ১৫-১৬ বছর বয়স থেকে মাইগ্রেনের লক্ষণ দেখা দেয় এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ৪০-৫০ বছর বয়স পর্যন্ত স্থায়ী হয়।
মাইগ্রেনের লক্ষণ
১. মাথার যেকোনো এক পাশে ব্যথা হয়। একবার এক পাশে ব্যথা হলে পরবর্তীবার অন্য পাশেও ব্যথা হতে পারে।
২. ৪ ঘণ্টা থেকে ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত ব্যথা স্থায়ী হতে পারে।
৩. রক্তনালি (ধমনি/শিরা) সংকোচন/প্রসারণ বা টনটন প্রকৃতির ব্যথা অনুভূত হয়।
৪. ব্যথা অত্যন্ত তীব্র হয় এবং এ সময় কোনো কাজ করা যায় না।
৫. আলো বা শব্দে ব্যথার তীব্রতা বেড়ে যায়।
৬. ব্যথার সঙ্গে বমি ভাব বা বমি হতে পারে।
৭. ব্যথা শুরুর আগে চোখের সামনে আলোর নাচানাচি, আঁকাবাঁকা লাইন (অরা) ইত্যাদি দেখে রোগী মাইগ্রেনে আক্রান্ত হতে পারে বলে বুঝতে পারে।
৮. অন্ধকার ঘরে শুয়ে থাকলে ব্যথার তীব্রতা কমে।
টেনশন টাইপ হেডেক
৭০ ভাগ বয়স্ক মানুষের এই ধরনের মাথাব্যথা হয়ে থাকে। টেনশন টাইপ হেডেকও মাইগ্রেনের মতো কৈশোরে শুরু হয় এবং নারীদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। মাথার মাংসপেশির সংকোচনের কারণে এই মাথাব্যথা হয়।
টেনশন টাইপ হেডেকের লক্ষণ
১. পুরো মাথায় ব্যথা হয়।
২. একটা চাপ চাপ বা ব্যান্ডের মতো ব্যথা অনুভূত হয়।
৩. ব্যথা মাইগ্রেনের মতো ততটা তীব্র হয় না। রোগী ব্যথা নিয়ে সব ধরনের কাজকর্ম করতে পারেন; বরং কাজের সময় ব্যথা অনুভব করা যায় না কিন্তু কাজ শেষ করলেই আবার মাথাব্যথা ফিরে আসে।
৪. সাধারণত মাথাব্যথার সঙ্গে বমি ভাব বা বমি হয় না।
৫. এই মাথাব্যথা কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক দিন পর্যন্ত থাকতে পারে।
৬. দুশ্চিন্তা, পারিবারিক বা পেশাগত বা মানসিক চাপের সঙ্গে এই মাথাব্যথার সম্পর্ক আছে।
ক্লাস্টার হেডেক
তুলনামূলকভাবে ক্লাস্টার হেডেক অনেক কম দেখা যায়। শূন্য দশমিক ১ ভাগ মানুষের এই ধরনের মাথাব্যথা হয়। পুরুষদের মধ্যে এই ধরনের মাথাব্যথার প্রকোপ বেশি। আনুমানিক হার পুরুষ: মহিলা=৬:১। সাধারণত ২০ বছর বয়সের পরে ক্লাস্টার হেডেক দেখা যায়।
ক্লাস্টার হেডেক লক্ষণ
১. ক্ষণস্থায়ী, তবে বারবার হয়।
২. অত্যন্ত তীব্র ব্যথা হয়।
৩. চোখের চারপাশে বা পেছনে ব্যথা হয়।
৪. চোখ লাল হয়ে যায় এবং পানি পড়ে। চোখের ওপরের পাতা পড়ে যেতে পারে।
৫. প্রতিদিন একই সময়ে বা দিনে কয়েকবার ব্যথা হয় এবং কয়েক সপ্তাহব্যাপী স্থায়ী হয়। এরপর ব্যথা চলে যায় এবং কয়েক মাস বা বছর পর আবার একইভাবে ব্যথা আরম্ভ হয়।
সেকেন্ডারি হেডেক
শারীরিক বা মাথার বিভিন্ন রোগের কারণে মাথাব্যথা হতে পারে। এসব মাথাব্যথাকে সেকেন্ডারি হেডেক বলে। যেমন (টাইফয়েড, ভাইরাল), মস্তিষ্কের আবরণে প্রদাহ (ভাইরাল, ব্যাকটেরিয়ার বা টিউমারফুলার মেনিনজাইটিস), সাইনোসাইটিস, মাসটয়েডাইটিস, মস্তিষ্কের টিউমার, রক্তক্ষরণ বা স্ট্রোক (এসএএইচ), মাথায় আঘাতজনিত কারণ ইত্যাদি।
রোগনির্ণয় ও চিকিৎসা
বিশ্বে মাথাব্যথার অধিকাংশ রোগীই জীবনে কখনো মাথাব্যথার জন্য চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয় না; বরং নিজেরাই ফার্মেসি থেকে বেদনানাশক বিভিন্ন ওষুধ কিনে খায়। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, খোদ যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে গত এক বছরে মাত্র ৫০ শতাংশ মাইগ্রেনের রোগী চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েছেন।
দেখা গেছে, সেকেন্ডারি হেডেকের রোগীদের নানা ধরনের শারীরিক উপসর্গ (যেমন অতিরিক্ত বমি, দৃষ্টিশক্তি হ্রাস, হাত, পা বা মুখ অবশ বা নিসাড় হওয়া, খিঁচুনি হওয়া ইত্যাদি) দেখা দিলে তবেই চিকিৎসকের পরামর্শের জন্য হাসপাতাল বা চিকিৎসকের চেম্বারে যায়।
এখন চিকিৎসাবিজ্ঞানের অনেক উন্নতির ফলে অতি সহজে মাথাব্যথার রোগ নির্ণয় করা সম্ভব। সিটি স্ক্যান, এমআরআই বা পিইটি স্ক্যানের মাধ্যমে মাথার বিভিন্ন অংশের সুস্পষ্ট ইমেজ পাওয়া যায়; ফলে মাথাব্যথার কারণ উদ্ঘাটন সম্ভব হয়েছে।
মাথাব্যথার ধরন বা কারণ অনুযায়ী চিকিৎসা দিতে হয়। এ জন্য প্রথমে প্রয়োজন রোগ নির্ণয় করা।
প্রাইমারি হেডেকের চিকিৎসা দুই স্তরে করতে হয়
১. অ্যাবরটিভ চিকিৎসা বা মাথাব্যথা তাৎক্ষণিক নিরাময় করা। এ জন্য বিভিন্ন বেদনানাশক ওষুধ সেবন করা যেতে পারে; যেমন প্যারাসিটামল, অ্যাসপিরিন, ন্যাপ্রোক্সেন, টলফেনামিক অ্যাসিড, ডাইক্লোফেন, ইনডোমিথাসিন–জাতীয় বেদনানাশক ওষুধ সেবনে ব্যথা দ্রুত নিরাময় হয়। মনে রাখতে হবে, এসব বেদনানাশক ওষুধের সঙ্গে অবশ্যই পেপটিক আলসারনিরোধী ওষুধ, যেমন রেনিটিডিন, ওমেপ্রাজল, ইসোমিপ্রাজল, প্যান্টোপ্রাজল খেতে হবে। অতিরিক্ত বেদনানাশক ওষুধ সেবনেও আবার মাথাব্যথা হতে পারে, যাকে মেডিসিন ওভার ইউজ হেডেক বলা হয়। তাই খুব প্রয়োজন ছাড়া বেদনানাশক ওষুধ সেবন উচিত নয়।
২. প্রোফাইলেকটিক চিকিৎসা: বারবার মাথাব্যথা যেন না হয় এবং ব্যথার তীব্রতা যেন কম থাকে, সে জন্য দীর্ঘমেয়াদি যেসব ওষুধ সেবন করতে হয়। এটাই প্রোফাইলেকটিক চিকিৎসা। এ ক্ষেত্রে সেবন করতে হয় অ্যামিট্রিপটাইলিন, নরট্রিপটাইলিন, প্রোপানল, সোডিয়াম ভ্যালপ্রোয়েট, টোপিরামেট ইত্যাদি ওষুধ।
ওষুধের পাশাপাশি কিছু কিছু অভ্যাসও পরিবর্তন করতে হবে। অতিরিক্ত ধূমপান, মদ্যপান, মাদক সেবন, চা ও কফি পান, অনিয়মিত ও অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ সেবন, রোদ বা অতিরিক্ত গরম আবহাওয়া, অতিরিক্ত শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রম, ক্ষুধার্ত থাকা, যেকোনো ধরনের মানসিক চাপ ইত্যাদি মাথাব্যথার কারণ। তাই এসব অভ্যাসের পরিবর্তন এবং সমস্যার সমাধান করলে মাথাব্যথা অনেকাংশে কমে আসবে।
পাশাপাশি ইতিবাচক জীবনচর্চা, সুনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস, শারীরিক ও মানসিক বিশ্রাম, পর্যাপ্ত ঘুম, মেডিটেশন ইত্যাদি মাথাব্যথার প্রকোপ কমাতে সাহায্য করে।
সেকেন্ডারি হেডেক
সেকেন্ডারি হেডেকের চিকিৎসার জন্য সাধারণত যে কারণে মাথাব্যথা হচ্ছে, সে কারণের চিকিৎসা করতে হবে। একজন নিউরোলজিস্টের তত্ত্বাবধানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করে যথাযথ চিকিৎসায় রোগ নিরাময় সম্ভব।
লেখক: অধ্যাপক, ক্লিনিক্যাল নিউরোলজি বিভাগ, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতাল