কসমেটিক সার্জারি: কী, কেন ও কখন
মানুষ আর্থিক সচ্ছলতার পাশাপাশি আত্মসচেতন হয়ে ওঠে। তাই এখন আত্মবিশ্বাসী, আত্মপ্রত্যয়ী মানুষ নিজেকে উপস্থাপন করতে বাহ্যিক সৌন্দর্যের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। একটা প্রবাদ আছে, ‘আগে দর্শনধারী তারপর গুণবিচারী’। সুদর্শন মানুষের প্রতি সবার আকর্ষণ জন্মগত।
গোত্র, বর্ণ অনুযায়ী মানুষের শরীরের বিভিন্ন অংশের (নাক, চোখ, ঠোঁট ইত্যাদি) গড়নও বিভিন্ন হয়ে থাকে। জন্মগত কারণ, দুর্ঘটনায় অঙ্গহানি, ক্যানসার বা পুড়ে যাওয়ার কারণের মানুষের সৌন্দর্যহানি ঘটতে পারে। তবে এখন শরীরের আক্রান্ত অংশের গঠন ফিরিয়ে আনা, তারপর সেই অংশের কাজ পুনরুদ্ধার করা, পরিশেষে সৌন্দর্য রক্ষা করা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। উন্নত বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও অ্যাসথেটিক বা কসমেটিক সার্জারি খুব সাফল্যের সঙ্গেই চলছে।
কী কী কসমেটিক সার্জারি হচ্ছে
১. দুর্ঘটনায় সৌন্দর্য বা পুড়ে যাওয়া অংশের সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনতে কসমেটিক সার্জারি একটি সাধারণ প্রক্রিয়া। কিছু কিছু ক্ষেত্রে একাধিকবার অস্ত্রোপচার লাগতে পারে। অগ্নিদগ্ধ রোগীর ক্ষেত্রে অনেক সময় পুড়ে যাওয়ার কারণে কাঁধ, হাত, পা ইত্যাদি অঙ্গের টিস্যু শক্ত হয়ে গিয়ে সেগুলোর স্বাভাবিক সঞ্চালন বাধাগ্রস্ত হয়। রোগীর এসব অঙ্গ ব্যবহার করে কাজকর্ম করা অনেকটা সীমিত হয়ে পড়ে। সে ক্ষেত্রে পুড়ে যাওয়া অঙ্গের শক্ত হয়ে যাওয়া টিস্যু অপসারণ করে শরীরের অন্য কোনো অংশের সুস্থ টিস্যু প্রতিস্থাপন করে সেই অঙ্গের স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়। ঠোঁটকাটা বা তালুকাটা সমস্যাও এমন সার্জারির মাধ্যমে সারিয়ে তোলা যায়।
২. বডি কনট্যুরিং বা বডি শেপিং সার্জারি: স্থূলতার কারণে আমাদের শরীরের অ্যানাটমিক্যাল শেপ বা আকৃতির পরিবর্তন হয়, যাতে সৌন্দর্যহানি ঘটে। এর সঙ্গে অতিরিক্ত চর্বির কারণে নানা রোগের উদ্ভব হয়। ডায়েট, শরীরচর্চার মাধ্যমে স্থূলতা কমলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার বা সার্জিক্যাল প্রসিডিওরের মাধ্যমে শারীরিক সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনা যায়। যেমন লাইপোসাকশন (চর্বি অপসারণ), ব্রাকিপ্লাস্টি (বাহুর অতিরিক্ত চামড়া অপসারণের মাধ্যমে ত্বক টান টান করা), পেটের অতিরিক্ত চর্বি অপসারণ, লাভ হ্যান্ডেলিং এরিয়া, ঘাড়ের অতিরিক্ত চর্বি অপসারণ, ডাবল চিন চর্বি অপসারণের মাধ্যমে উপস্থাপনযোগ্য শারীরিক অবয়ব প্রদান করা সম্ভব।
৩. ব্রেস্ট অগমেন্টেশন, রিডাকশন, মাস্টোপেক্সি: অনেক কারণে মেয়েদের স্তনের আকার ছোট, বড় হতে পারে কিংবা ঝুলে যেতে পারে। ফ্যাট গ্রাফটিং অথবা ইমপ্ল্যান্টের মাধ্যমে স্তন বড় করা সর্বোপরি এর সৌন্দর্য বাড়ানো যেতে পারে।
অতিরিক্ত বড় স্তনকে আধুনিক সার্জারির মাধ্যমে জুতসই আকারে আনা সম্ভব। ঝুলে যাওয়া স্তনকে কুমারীর মতো গঠন দেওয়া যেতে পারে। এমনকি স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীদের স্তন থেকে ক্যানসার অপসারণ করাও সম্ভব অনকোপ্লাস্টিক ব্রেস্ট সাজারির মাধ্যমে।
৪. অ্যাবডোমিনোপ্লাস্টি, লাইপোসাকশন: অতিরিক্ত চর্বির কারণে পেটের স্থূলভাব ধারণ করে এবং চামড়া ঝুলে পড়তে পারে। লাইপোসাকশন অথবা অ্যাবডোমিনোপ্লাস্টি (টামিটাক অপারেশন) অথবা দুটি পদ্ধতি একসঙ্গে ব্যবহার করে পেটের সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
৫. গাইনেকোমেশিয়া: পুরুষদের অযাচিত স্তন বড় হলে তাঁরা সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হতে পারেন। সে ক্ষেত্রে লাইপোসাকশন বা দাগবিহীন সার্জারির মাধ্যমে উপস্থাপনযোগ্য, পুরুষালি শারীরিক গঠন দেওয়া সম্ভব।
৬. রাইনোপ্লাস্টি: ভোঁতা নাক, নাকের বাঁশি বাঁকা অথবা প্রসারিত নাকের মানুষেরা অ্যাসথেটিক রাইনোপ্লাস্টির মাধ্যমে সুন্দর নাকের অধিকারী হতে পারেন।
৭. লিপ অগমেন্টেশন/রিডাকশন: পুরু ঠোঁটকে চিকন করা এবং পাতলা ঠোঁটকে ফ্যাট গ্রাফটিং বা ফিলারের মাধ্যমে পুরু করে তোলা।
৮. ব্লেফারোপ্লাস্টি: কোঁচকানো চোখের পাতা (ওপর/নিচ) সার্জারির মাধ্যমে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বোটক্স থেরাপির মাধ্যমে ত্বক টান টান করা সম্ভব।
৯. ব্রাউপ্লাস্টি: ভুরুর সৌন্দর্য বাড়ানোর অস্ত্রোপচার।
১০. ফেস লিফট: সার্জিক্যাল এবং নন–সাজিক্যাল পদ্ধতিতে মুখমণ্ডলের কোঁচকানো চামড়া টান টান করা যায়।
১১. বাট লিফট: অনেকেই নিতম্বের সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য আসেন। ফ্যাট গ্রাফটিং বা ইমপ্ল্যান্টের মাধ্যমে নিতম্বের গঠন আকর্ষণীয় করা সম্ভব।
১২. ভ্যাজাইনোপ্লাস্টি: অতিরিক্ত বাচ্চা প্রসবের কারণে বা অন্য কোনো কারণে নারীর জননেন্দ্রীয় ঢিলেঢালা হয়ে যায়, যার ফলে তাঁদের শারীরিক সম্পর্ক আনন্দদায়ক হয় না। সার্জারির মাধ্যমে এ সমস্যা দূর করা যায়।
১৩. ফ্যাট গ্রাফটিং, ফিলার: শরীরের যেকোনো ছোটখাটো অসংগতি দূর করা যায়।
দেশেই এখন এমন সার্জারি হচ্ছে কোনো সমস্যা ছাড়াই। দুর্ঘটনা–পরবর্তী বিভিন্ন অঙ্গের আকৃতি আগের মতো বা সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনতে কসমেটিক সার্জারির কোনো বিকল্প নেই।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক (বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি), শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, গাজীপুর