‘র্যাগ দেওয়ার’ সঙ্গে কি ভালো সিনিয়র হওয়ার সম্পর্ক আছে?
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় তরুণদের কাছে একটা স্বপ্ন। কলেজজীবন থেকে যার শুরু, তুমুল প্রতিযোগিতামূলক ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ‘চান্স’ পাওয়ার মাধ্যমে পূর্ণতা পায় সেই স্বপ্নের। তবে এই স্বপ্নিল জীবনেও কখনো কখনো দুঃস্বপ্নের আতঙ্কে তটস্থ থাকতে হয়, যে দুঃস্বপ্নের নাম র্যাগিং।
বাংলাদেশের অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই র্যাগিং একটা নিষ্ঠুর বাস্তবতা। র্যাগিংয়ের শিকার হয়ে এমনকি মৃত্যুর মতো ঘটনাও ঘটেছে। মারধর, হেনস্তার খবর আমরা পত্রিকায় পড়েছি। এর বাইরে দল বেঁধে দাঁড় করিয়ে রাখা, নাচ-গান করানো, কান ধরানো বা অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করতে বাধ্য করাকে অনেক ক্যাম্পাসে ‘স্বাভাবিক’ বলে ধরে নেওয়া হয়। অনেকে আবার মনে করেন, ‘র্যাগ না দিলে’ ভালো সিনিয়র হওয়া যায় না।
আসলেই কি তা–ই?
বিভিন্ন সময় করা গবেষণা থেকে উঠে এসেছে, ইউনিভার্সিটিতে র্যাগিংয়ের নামে যে শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনগুলো করা হয়, এগুলোর ফলে বহু শিক্ষার্থীরই স্বাভাবিক বিকাশ ও উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন; হতাশা, বিষণ্নতা বা একাকিত্ব এসে ভর করে; এমনকি চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে কেউ কেউ আত্মহত্যাকে ‘সব সমস্যার সমাধান’ হিসেবে ভাবতে শুরু করেন। প্রথম-দ্বিতীয় বর্ষের এই তিক্ত অভিজ্ঞতা অনেকে ভুলতে পারেন না। সময়ে-অসময়ে নানা আচরণে, নানাভাবে বেরিয়ে আসে সেসব তিক্ততার কথা। বেশির ভাগ সময়ই এই র্যাগিং রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক বাস্তবতা হয়ে দেখা দেয়। সে ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের হস্তক্ষেপ বা আইনের সহায়তা ছাড়া সমস্যার সমাধান হওয়া কঠিন।
কাজেই র্যাগিং কখনোই কাউকে ভালো সিনিয়র হতে সাহায্য করে না, বরং জুনিয়রদের কাছে ভয়ংকর এক নেতিবাচক চরিত্র হিসেবে তুলে ধরে। তাই র্যাগ দেওয়ার সঙ্গে ভালো সিনিয়র হওয়ার কোনো সম্পর্ক তো নেই-ই, বরং ‘খারাপ’ সিনিয়র হওয়ার গভীর সম্পর্ক আছে।
তাহলে কীভাবে হবেন ভালো সিনিয়র?
ভালো সিনিয়র চাইলে অনেকভাবেই হওয়া যায়। যেমন—
দেখা হলে জুনিয়রদের খোঁজখবর নেওয়া, হাসিমুখে কথা বলা। মনে রাখবেন, প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা নিজেদের পরিবার, বাড়ি এবং পরিচিত শহর ছেড়ে এসেছেন। এখানে আপনারাই তাঁদের পরিবার এবং আপনার একটু হাসিমুখে কথা বলা বা কুশল জিজ্ঞাসা করাটাও তাঁকে অনেক শক্তি দেয়, নতুন পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সাহায্য করে। আপনি যে সমস্ত দিকে এগিয়ে, সেসব ক্ষেত্রে জুনিয়রদের সাহায্য করুন। বিপদে পাশে দাঁড়ান।
ভালো সিনিয়র হওয়ার আরেকটা উপায় হলো ভালো শ্রোতা হওয়া। সিনিয়র হওয়ার সুবাদে যদি আপনি ক্রমাগত জুনিয়রদের ওপর খবরদারি করতে থাকেন বা উপদেশ দিতেই থাকেন, তাহলে দিন শেষে আপনি বিরক্তিকর একজন মানুষে পরিণত হবেন।
মাত্রাবোধ এবং পরিমিতিবোধ বজায় রাখা। বেশির ভাগ সময়ই সিনিয়ররা এই ভুলটা করে ফেলেন। জুনিয়রের ভালো করতে গিয়ে তাঁদের ব্যক্তিগত বিষয়েও নাক গলাতে শুরু করেন, যেটা পরবর্তী সময়ে সম্পর্ক নষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মনে রাখতে হবে, আপনার জুনিয়রও একজন পরিপূর্ণ মানুষ। তাঁর জীবনদর্শন বা পদ্ধতি আপনার থেকে ভিন্ন হতেই পারে, এটা নিয়ে কথা বলতে গেলে সেটা অনধিকারচর্চা হয়ে যাবে।
জুনিয়রদের ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে শিখুন। হলে বা ক্যাম্পাসে জুনিয়রদের সব সময়ই তটস্থ অবস্থায় থাকতে হয়। ভুল করে ফেললেই দাঁড়াতে হয় সিনিয়রদের কাঠগড়ায়। খেতে হয় ধমক বা বকা। এই চর্চা থেকে বের হয়ে আসুন। ভুল হলে ডেকে ধরিয়ে দিন। যে কাজটা ভালোবাসার মাধ্যমেই করা যায়, সেই কাজ রূঢ় হয়ে কেন করতে হবে?
একসঙ্গে সবাই মিলে খেলাধুলা, চড়ুইভাতি বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারেন। এই আয়োজনগুলোতে কাজ করতে গিয়ে পরিচিত না হয়েও অনেক সময়ই সিনিয়র-জুনিয়রদের মধ্যে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যা পরবর্তী জীবনেও বহাল থাকে।
মোদ্দাকথা হলো, সিনিয়র হিসেবে আচরণ করার আগে জুনিয়রদের জায়গায় নিজেকে কল্পনা করতে জানতে হবে। সব সময়ই শাসন বা ঠিক-ভুলের নিক্তিতে সবকিছু না মেপে সহানুভূতির দৃষ্টিতেও অনেক কিছু দেখতে হবে। আপনি নিজে যখন জুনিয়র ছিলেন, তখন আপনি যেমন সিনিয়র মনে মনে প্রত্যাশা করতেন, আপনার নিজেরও উচিত তেমন সিনিয়র হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলা।