প্রেনচ্যুংয়ের জীবনের গল্পটাও ‘রেকর্ডে’ থাকার মতো
‘যখন কোথাও খেলতে যাই, সবাই বলে, “তুমি চাকমা, মারমা না ত্রিপুরা?” আমি বলার চেষ্টা করি, আমি ম্রো। ম্রো কী, ম্রো কারা, অনেকেই বোঝেন না। জানেন না যে ম্রো নামে একটা জাতি আছে। আমি শুধু সবার কাছে আমার জাতির নাম পৌঁছে দিতে চেয়েছিলাম,’ বলছিলেন প্রেনচ্যুং ম্রো। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থী সম্প্রতি গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম লিখিয়েছেন। ভালো ফুটবল খেলেন। সেই সুবাদেই সম্প্রতি মিনিটে ২০৮ বার টোকা দিয়ে ফুটবল শূন্যে ভাসিয়ে রেখে রেকর্ড গড়েছেন তিনি।
পাহাড়ের মতোই চড়াই–উতরাইয়ে ভরা এই পাহাড়ি তরুণের জীবন। দুই ভাই ও তিন বোনের মধ্যে প্রেনচ্যুং সবার ছোট। জন্ম বান্দরবানের লামা পাড়ায়। স্থানীয় একটি এনজিওতে চাকরি করতেন বাবা। আর মা করতেন কৃষিকাজ। সকালেই মাঠে যেতেন, ধানের সময় ধান, শীতকালে শাকসবজি, ইত্যাদি চাষ করতেন। আগে থেকেই হৃদ্রোগ ছিল, অতিরিক্ত পরিশ্রমের ব্যাপারে চিকিৎসকের নিষেধাজ্ঞাও ছিল। কিন্তু সেসবের ধার ধারেননি মা। একদিন হঠাৎই স্ট্রোক করে চিরদিনের জন্য শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন তিনি। প্রেনচ্যুং ম্রোর বয়স তখন মাত্র পাঁচ বছর।
মায়ের সঙ্গে ঘরবন্দী
যে বয়সে খেলাধুলা আর বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে ছোটাছুটি করে কাটানোর কথা, সেই বয়সেই মায়ের আকস্মিক অসুস্থতা ঘরবন্দী করে ফেলে প্রেনচ্যুংয়ের জীবন। পড়ালেখার সূত্রে ভাই-বোনেরা সবাই তখন বাড়ির বাইরে। স্বাভাবিকভাবে সব চাপ প্রেনচ্যুং ও তার বাবার ওপর এসে পড়ে।
ছোট্ট প্রেনচ্যুংয়ের তখন দুটিই কাজ ছিল। পড়ালেখা আর মায়ের সেবা। মাকে খাওয়ানো থেকে শুরু করে মলমূত্র পরিষ্কার, সবই করতেন তিনি। এভাবে মায়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রেনচ্যুংও হয়ে পড়েন গৃহবন্দী। ‘মাঝেমধ্যে কান্নাকাটি করতাম। বন্ধুরা ডাকত, কিন্তু খেলতে যেতে পারতাম না,’ বলছিলেন প্রেনচ্যুং।
বাবা পিয়াচ্যং ম্রো ছিলেন অষ্টম শ্রেণি পাস। কর্মজীবনে বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছেন, বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের সঙ্গে মিশেছেন। পড়ালেখার মর্ম তিনি জানতেন। তাই তাঁর কথা ছিল, ঠিকমতো খেতে পারি বা না পারি, লেখাপড়াটা ঠিকঠাক করতে হবে। এ কারণেই দিনরাত শয্যাশায়ী মায়ের পাশে থাকলেও স্কুল, প্রাইভেট বন্ধ রাখেননি প্রেনচ্যুং। ছেলে যতক্ষণ স্কুলে থাকত, স্ত্রীর দেখাশোনা করতেন পিয়াচ্যং। পাশাপাশি অন্যান্য সাংসারিক কাজও সামলাতেন। এভাবে চলতে চলতে একসময় চাকরিটাও হারান তিনি।
খ্যাপে খেলে সংসার
বাবার চাকরি নেই, মা শয্যাশায়ী, অন্য ভাইবোনেরা পড়ালেখা করছে। সংসার চালাতে হিমশিম দশা। অতএব ক্লাস নাইন-টেন থেকে খ্যাপে খেলা শুরু করেন প্রেনচ্যুং। খেলা হতো, উপার্জনও হতো। দুই দিক সামলাতে গিয়ে পড়ালেখার অবশ্য একটু ক্ষতি হয়ে গেছে। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় খুব একটা ভালো ফল করতে পারেননি।
মাধ্যমিকের পর ভর্তি হন বান্দরবান সরকারি কলেজে। বাড়ি থেকে ৯-১০ কিলোমিটার দূরে ক্যাম্পাস। রোজ না খেয়ে সকাল ছয়টায় বের হতে হতো। দুপুরবেলায় কোনোরকম নাশতা করতেন। তারপর স্কুল, প্রাইভেট শেষ করে বাসায় ফিরতেন। করতেন মায়ের দেখাশোনা। সেটাও সহজ নয়। প্রেনচ্যুং বলছিলেন, ‘অসুস্থতার কারণে সারা রাত ঘুমাতে পারতেন না মা। বাচ্চাদের মতো হয়ে গিয়েছিলেন।’
একটু স্বস্তির দেখা, কিন্তু…
এইচএসসির পর বোনেরা চাইতেন, প্রেনচ্যুং কোনো একটা চাকরি করুক। কিন্তু তাঁর ছিল পড়ালেখায় ঝোঁক। পুরোদমে প্রস্তুতি নিতে থাকেন তিনি। সুযোগ পেয়ে যান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা ও ক্রীড়াবিজ্ঞান বিভাগে। বিষয় ফুটবল। সে সময়ের স্মৃতিচারণা করে প্রেনচ্যুং বলেন, ‘শুধু বাবার উৎসাহে আমি পড়ালেখা চালিয়ে গেছি। মেধাতালিকায় নাম আসার পর বাবাকে কল দিই। খুশিতে আত্মহারা বাবা বলেছিলেন, “তুমিই আমার শেষ, তুমিই আমার শুরু।” কথাটা এখনো মনে পড়ে।’
এই সুখ বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। সে বছরই মায়ের মতো বাবারও স্ট্রোক হয়। এ হাসপাতাল থেকে ওই হাসপাতাল, এখান থেকে ওখানে ছোটাছুটি করেও শেষ পর্যন্ত তাঁকে বাঁচানো যায়নি। বাবার শোক সামলে ওঠার আগেই, মাত্র চার মাসের ব্যবধানে, মারা যান মা-ও। কিছুদিন পর মারা যান দাদি।
খেলাধুলায় খোঁজা অনুপ্রেরণা
২০১৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন প্রেনচ্যুং। সে বছরই বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুটবল দলে সুযোগ পান। করোনাকালে দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়। প্রেনচ্যুং থেমে থাকেননি, প্রশিক্ষণ চালিয়ে গেছেন। করোনাকালের পর বান্দরবান জেলা দলের হয়ে খেলার সময় তাঁকে পছন্দ করেন নির্বাচকেরা। ভাগ্য খুলে যায়। বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে ঢাকা ফোরটিজ এফসির হয়ে তিনি প্রথম লিগ পর্যন্ত খেলেন। এরপর ২০২০-২১ সিজনে ব্রাদার্স ইউনিয়নের হয়ে খেলেছেন চিটাগং প্রিমিয়ার লিগ। সেবার চ্যাম্পিয়ন হয় ব্রাদার্স ইউনিয়ন। এ ছাড়া স্থানীয়, জাতীয় পর্যায়ের আরও বহু খেলায় দৃপ্ত পায়ে মাঠ কাঁপিয়েছেন প্রেনচ্যুং।
গত বছর ইউটিউবে বিভিন্ন ভিডিও দেখতে দেখতে চোখে পড়ে, নানাভাবেই গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম লেখানোর সুযোগ আছে। তখন গিনেসের ওয়েবসাইটে অ্যাকাউন্ট খোলেন প্রেনচ্যুং। ফরম পূরণ করে নির্দিষ্ট বিভাগ বাছাই করেন। এক মাস পর তাঁকে ভিডিও জমা দিতে বলে গিনেস কর্তৃপক্ষ। ভিডিও আর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাঠানোর পর এক মাস, দুই মাস, চার মাস পেরিয়ে গেলেও কোনো সাড়া মিলছিল না। একপ্রকার আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন প্রেনচ্যুং। অবশেষে ছয় মাস পর বার্তা আসে—গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড গড়েছেন প্রেনচুং ম্রো।