জাহাঙ্গীরনগরে কেটেছে আতঙ্ক; বদলে গেছে হল, গেস্টরুম, ক্যানটিনের চিত্র
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের অতিথিকক্ষটি (গেস্টরুম) পরিপাটি করে সাজানো। একদিকে দুই শিক্ষার্থী একাডেমিক পড়ালেখায় ব্যস্ত, অন্যদিকে সোফায় বসে পাঁচ শিক্ষার্থী কী নিয়ে যেন আলাপ করছিলেন। কথা বলে জানা গেল, তাঁরা ‘গ্রুপ অ্যাসাইনমেন্ট’ করছেন। দক্ষিণ দিকের নতুন যে সোফা, সেখানে বসে খোশগল্পে মেতে ছিল পাঁচ থেকে ছয়জনের একটি দল। সবার মুখে হাসি।
১১ সেপ্টেম্বরের দৃশ্য এটি। গেস্টরুমে খোশগল্পে মেতে থাকা দলটির সঙ্গে যোগ দিই। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী মো. রহমাতুল্লাহ বলেন, ‘মনের আনন্দে আড্ডা দিচ্ছি, তাই মন খুলে হাসছি। ম্যানার শেখার ভয় নাই।’
শিক্ষার্থীরা জানান, মাস দুয়েক আগে এই ‘গেস্টরুম’ সাধারণ শিক্ষার্থী, বিশেষত প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের কাছে ছিল এক আতঙ্কের নাম। রাত হলেই জুনিয়র শিক্ষার্থীদের ডেকে নিয়ে ‘ম্যানার’ শেখানোর নামে চলত অমানুষিক নির্যাতন। পান থেকে চুন খসলেই শুরু হতো গালিগালাজ, হট্টগোল। নামে গেস্টরুম হলেও ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীদের ‘আড্ডাস্থল’ হিসেবেই ছিল পরিচিতি। এখন পরিস্থিতি ভিন্ন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসনসংকটও কেটে গেছে বলে দাবি করলেন শিক্ষার্থীরা। তাঁদের ভাষ্য, নামে আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হলেও জাহাঙ্গীরনগরে গত কয়েক বছর ছিল তীব্র আবাসনসংকট। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ঠাঁই হতো গণরুমে। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের শুরুতেই ‘গণরুম সংস্কৃতিতে’ পড়ে অনেক শিক্ষার্থীই আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলতেন।
হলগুলোয় ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িত নেতা-কর্মীদের একচ্ছত্র আধিপত্যের কারণে কৃত্রিম আবাসনসংকট ছিল প্রবল। কিন্তু ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের পতনের পর চিত্রপট পাল্টেছে। ছাত্রলীগকে ক্যাম্পাসে একধরনের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছেন শিক্ষার্থীরা। বেশির ভাগ হল গণরুম-মিনিগণরুমমুক্ত হয়েছে। কোনো কোনো হলে ‘রাজনীতিমুক্ত হল’ ব্যানার টানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। এখন নেই র্যাগিং বা গেস্টরুম সংস্কৃতি।
হাওয়াবদল
বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে থাকতেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান। নিজে অছাত্র হলেও এই হলের একাত্তর ব্লকের তিনতলায় চার আসনের দুটি কক্ষে তিনি একাই থাকতেন। শুধু হাবিবুর নন; ওই হলে অন্তত ৩০টি কক্ষ অছাত্ররা দখল করে রেখেছিলেন। বেশির ভাগ কক্ষেই নেতারা একা থাকতেন। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আরাম-আয়েশে থাকলেও একটি সিটের আশায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের রীতিমতো যুদ্ধ করতে হতো। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তৃতীয় বর্ষ পেরিয়ে গেলেও একটি সিট জুটত না। বাধ্য হয়ে অনেকে বাইরে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতেন। সেই চিত্রও এখন পাল্টেছে। যে হলে শিক্ষার্থীরা আসন না পেয়ে বাইরে থাকতেন, গণরুমে থাকতেন, সেই হলে সব শিক্ষার্থীকে তাঁর ন্যায্য আসন বুঝিয়ে দেওয়ার পরও অন্তত ১০০টি আসন ফাঁকা রয়েছে।
শুধু বঙ্গবন্ধু হল নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব হলেই একই রকম চিত্র চোখে পড়ল। মওলানা ভাসানী হলের তিনতলায় থাকতেন ছাত্রলীগের সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেল। চারজনের কক্ষে তিনি একাই থাকতেন। টিভি, ফ্রিজ, আয়েশি বিছানা, কী ছিল না তাঁর ঘরে! ওই হলেও অন্তত ২৫টি ঘর নেতা-কর্মীরা দখল করে রেখেছিলেন। আর সাধারণ শিক্ষার্থীরা আসন না পেয়ে ৪ জনের ঘরে ১০ থেকে ১২ জন থাকতেন। শিক্ষার্থী ও হল প্রশাসনের উদ্যোগে এখন আসন বণ্টন হয়েছে।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলে জুনিয়র শিক্ষার্থীদের ‘ম্যানার শেখানোর’ নামে পোশাক পরিধানে নিয়ম বেঁধে দিতেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। জিনস প্যান্ট ও ফুলহাতা শার্ট পরে চলাফেরা করতে হতো। এমনকি হলের ভেতরের খাবারের দোকানগুলোয় খাওয়ার ‘অনুমতি’ও জুনিয়র শিক্ষার্থীদের ছিল না। এখন তাঁরা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারছেন। প্রথম বর্ষের আবাসিক ছাত্র তারেক মুহাজির বলেন, ‘আগে হলের ওয়াশরুমে যেতে হলেও জিনস প্যান্ট আর ফুলহাতা শার্ট পরে যেতে হতো। অন্য পোশাকে দেখলেই ছাত্রলীগের ভাইয়েরা শাস্তি দিতেন। এখন আর সেই সমস্যা নেই।’
জনমবাকি, নাকি জনমফাঁকি?
বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ হলের ক্যানটিনে নির্দিষ্ট একটা টেবিল ছিল, যেখানে লেখা থাকত—ছাত্রলীগের জন্য বরাদ্দ। সেই টেবিলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা বসতে পারতেন না। অন্যদিকে মওলানা ভাসানী হলের ক্যানটিনে সাধারণ শিক্ষার্থীরা যে খাবার খেতেন, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা সেই একই খাবার খেতেন না। হলের ক্যানটিনে তাঁদের জন্য আলাদাভাবে ভালো মানের খাবার রান্না করা হতো। এখন সেই অবস্থা আর নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হলে ক্যানটিন ও নাশতার দোকান আছে। এর বাইরে হল এলাকায় শতাধিক দোকানপাট আছে। সব কটি থেকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা মাসিক হারে চাঁদা তুলতেন। ‘ফাও’ খেতেন। ‘জনমবাকি’ শব্দটির প্রচলনও তাঁদের জন্যই; অর্থাৎ আজীবনের জন্য তাঁরা বাকিতে খাবেন—এটাই ছিল অলিখিত নিয়ম। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বকেয়া বিল চাইলে আবাসিক হলের কক্ষে নিয়ে করা হতো নির্যাতন। তবে এখন আর সেই চিত্র নেই। দোকানদারদের এখন মাসিক চাঁদা দেওয়া লাগে না। ‘জনমবাকি’র চলও নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মুরাদ চত্বরের দোকানদার মোহাম্মদ কাজল বলেন, ‘আগে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা দলেবলে এসে খেয়ে চলে যেতেন। বলতেন পরে টাকা দেবেন। কিন্তু বাকি টাকা চাইলে হুমকি দিয়ে বলতেন, “ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যাচ্ছি নাকি?” পরে সেসব বাকির টাকা আর পেতাম না।’
ইন্টারনেটে এসেছে গতি
বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোয় ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা দিতে হলে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের এককালীন এক লাখ থেকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুই লাখ টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করত ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। এর বাইরে মাসিক ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা মাসোহারা দিত তারা। প্রতিটি হলেই ২০ থেকে ৪০টি ওয়াই-ফাই রাউটার ফ্রি চালাতেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। ফল ভোগ করতে হতো সাধারণ শিক্ষার্থীদের। মাসিক ৫০০ টাকা নিয়ে যে মানের সেবা দেওয়ার কথা থাকত, সেই মানের ইন্টারনেট সেবা দিতে পারত না প্রতিষ্ঠানগুলো। এ কারণে সাধারণ শিক্ষার্থীরা পেতেন দুর্বল গতির ইন্টারনেট, যা দিয়ে চাহিদা অনুযায়ী কাজ করতে বেশ বেগ পেতে হতো। এখন একই টাকা খরচ করে শিক্ষার্থীরা আগের চেয়ে দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা পাচ্ছেন।
প্রত্যাশা
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বলছেন, যেসব ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে, সেগুলো ধরে রাখা দরকার।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক পারভীন জলী বলেন, ‘এ বিশ্ববিদ্যালয়ে যে আবাসনসংকট ছিল, তার বেশির ভাগ ছিল কৃত্রিমভাবে ছাত্রলীগের সৃষ্টি। হলে আধিপত্য বজায় রাখতে তারা র্যাগিং, গণরুম কালচার চালু রেখেছিল। প্রশাসনের ছত্রচ্ছায়ায় তারা ক্যাম্পাসে নানা ধরনের নিপীড়ন চালিয়ে যেত। আমরা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখতে চাই না। নতুন বাংলাদেশে আমাদের নতুনভাবে ভাবতে হবে। হলে কোনো শিক্ষার্থী যেন আধিপত্যশীল হতে না পারে, ক্যাম্পাসে নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা যেন ফিরে না আসে, সে জন্য নতুন প্রশাসনকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।’