২০৫৩ সালের জুন মাসে কী ভিডিও দেব, সেটাও ঠিক করে ফেলেছি
নাসা, অ্যাপলের চাকরি ছেড়ে এখন তিনি পুরোদস্তুর ইউটিউবার। প্রকৌশলের কারিকুরি কাজে লাগিয়ে মজার সব ভিডিও তৈরি করেন। ১ জুন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বক্তা ছিলেন প্রকৌশলী মার্ক রবার।
তোমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আজ এখানে কথা বলাটা আমার জন্য অদ্ভুত একটা অভিজ্ঞতা। পৃথিবী যেভাবে দ্রুত বদলে যাচ্ছে, কী বললে আমার উপদেশ সময়োপযোগী হবে, ভেবেই খানিকটা চাপ বোধ করছি। এমনকি চার বছর আগের তুলনায় পৃথিবীটা অনেক বদলে গেছে। তোমরাই এমআইটির প্রথম স্নাতক, যারা একটা বৈশ্বিক মহামারি দেখেছ। এবং এটিই সম্ভবত পৃথিবীর প্রথম সমাবর্তন বক্তৃতা, যার পুরোটাই চ্যাটজিপিটির লেখা।
চ্যাটজিপিটি এখনো একেবারেই নতুন। অতএব আমি যদি কোনো ব্যাকরণগত ভুল করে ফেলি, কিংবা মানবজাতিকে ধ্বংস করা বা হুমকিতে ফেলার মতো কোনো কথা বলে ফেলি, সেই দায় কিন্তু আমার না, রোবটের!
আমি কিন্তু বহু আগে থেকেই আমার ভিডিওগুলোর পরিকল্পনা করে রাখি। এমনকি ২০৫৩ সালের জুন মাসে কী ভিডিও প্রকাশ করব, সেটাও এরই মধ্যে ঠিক করে ফেলেছি। সেই ভিডিও হবে তোমাদের নিয়ে। ২০২৩ সালের এমআইটি স্নাতকেরা কী অসাধারণ সব কাজ করেছিল, সেটাই হবে ভিডিওর বিষয়। এখন আমি যা বলছি, এটাই হবে ভিডিওর সূচনা। অতএব তোমরা যদি আমার কোনো ভিডিওর অংশ হতে চাও, আজই সুবর্ণ সুযোগ।
৩০ বছর পরও কি ইউটিউব থাকবে? আশা করি থাকবে। যদি না ইলন মাস্ক ইউটিউব কিনে নেয়।
এই ৩০ বছরে তুমি পৃথিবীতে যত ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে, ভিডিওতে তোমার জায়গা করে নেওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি। তাই আমার জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে তোমাদের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ দিতে চাই।
সরল আশাবাদ
প্রথম উপদেশ: সরল আশাবাদী হও।
সরল আশাবাদ বলতে কী বোঝাচ্ছি? এক মিনিট! যখন আমি ইউটিউবে ভিডিও বানাই, তখন এই পর্যায়ে এসে একটা মিউজিক বাজতে শুরু করে। আগে মিউজিকটা ছেড়ে নিই। তারপর বাকি কথা বলছি। (মিউজিক ছেড়ে দিয়ে) হ্যাঁ, এবার ঠিক আছে। যা বলছিলাম। সরল আশাবাদ মানে ভবিষ্যতের ব্যাপারে একধরনের সরল দৃষ্টিভঙ্গি। আমি কী জানি না, সেটাও আমি জানি না—এটা মেনে নেওয়া। এমআইটি–জীবনের প্রথম সপ্তাহটার কথাই ভাবো। কী সরল মনোভাব নিয়েই না তোমরা যাত্রা শুরু করেছিলে। যদি জানতে সামনে কী কী আসছে, তাহলে হয়তো শুরুতেই ভয় পেতে। কখনো কখনো কোনো অভিজ্ঞতা না থাকাটাই একটা আশীর্বাদ। তখন আর মর্যাদা ধরে রাখার ঝুঁকি থাকে না। খোলা মন নিয়ে নতুন কিছু শুরু করা যায়।
জীবনের বড় বড় সিদ্ধান্ত নিতেও সাহায্য করে এই সরল আশাবাদ। একটা শিশু যে মনোভাব নিয়ে হাঁটতে শেখে কিংবা তোমাদের মা যেভাবে টিকটক ব্যবহার করতে শেখেন, সরল আশাবাদ সেটাই। ২০ বছর পর তুমি কী করবে কিংবা করতে চাও, না জানার মধ্যে কোনো দোষ নেই। এমনকি তুমি যদি জেনেও থাকো, তাতে কিছু যায় আসে না। কারণ, তুমি ভুল জানো। কেউ যদি তোমাকে বলে যে সে ২০ বছর আগেই জানত সে আজ এখানে থাকবে, তাহলে হয় সে মিথ্যা বলছে, নয়তো সে একজন সময় পর্যটক (টাইম ট্রাভেলার)।
জীবন হচ্ছে একটা পাথুরে নদী পার হওয়ার মতো। তুমি যখন নদীর এক তীরে গিয়ে দাঁড়াবে, শুরুতে হয়তো পা দিয়ে কিছু নুড়িপাথর নাড়াচাড়ার সুযোগ পাবে। কিন্তু তারপর তোমাকে একটা বড় পাথর বেছে নিয়ে সেটার ওপর লাফ দিতে হবে। কারণ নদী গতিশীল, পরিবর্তনশীল। প্রথম পাথরটাকে যদি রূপক অর্থে তোমার শখ বলে ধরে নিই, কৌতূহল আর আগ্রহই তোমাকে পথ দেখাবে। যদি প্রথম পাথরটা হয় পেশাগত ক্যারিয়ার, তাহলে কৌতূহল আর আগ্রহ তো পথ দেখাবেই, সঙ্গে তুমি কিসে ভালো আর পৃথিবীর কী প্রয়োজন, সেটাও মাথায় রেখো। যে ‘পাথর’ই বেছে নাও না কেন, সেখানে তোমার আধিপত্য বিস্তার করো। জায়গাটা ভালো করে চেনো, বোঝো। ওস্তাদ হয়ে যাও।
পায়ের নিচে শক্ত পাথর পেয়ে গেছ তো? এবার সামনে তাকাও। নদীটা আরও ভালো করে দেখার চেষ্টা করো। এমন অনেক পাথর হয়তো তোমার চোখে পড়বে, যা তুমি তীরে দাঁড়িয়ে দেখোনি।
আমিও এভাবে কলেজ, নাসা, ইউটিউবের মতো একটার পর একটা পাথরে লাফ দিয়ে আজ এই এমআইটির পাথরে পৌঁছেছি।
২০ বছর আগে যখন তোমাদের অবস্থানে ছিলাম, আজকের কথা কখনো কল্পনাও করতে পারিনি। তাই বলব একটার পর একটা পাথরে লাফ দিয়ে জীবন নদীটা পেরিয়ে যাও। আর এই যাত্রায় যেন সরল আশাবাদই হয় তোমার পথনির্দেশক। নিজের ওপর বিশ্বাস রাখো। অনভিজ্ঞতাকে স্বাগত জানাও।
এখানে যারা পুরকৌশলী আছ, তারা হয়তো মুচকি হেসে বলছ, নদী পেরোতে গিয়ে অত লাফালাফির কী আছে? একটা সেতু বানিয়ে নিলেই হয়! দূর হও! আমার গল্প আমি আমার মতো করেই বলব। (হাসি)
হারব, জিতব
এবার কিছু বাস্তবতার কথা বলা যাক। অনেক সময় তুমি টের পাবে, পায়ের নিচের পাথরটা অত শক্ত নয়। একটু নড়বড়ে। কয়েকবার হয়তো তুমি পানিতে পড়েও যাবে। এই প্রসঙ্গেই আসছে আমার দ্বিতীয় উপদেশ—ব্যর্থতাকে কাজে লাগাও।
আমার সাবস্ক্রাইবারদের মধ্যে ৫০ হাজার জনকে একটা কম্পিউটার পাজল গেম (ধাঁধার খেলা) খেলার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। কিন্তু তারা জানত না, আমি আসলে দুই ধরনের পাজল বানিয়েছি। একটা পাজলের নিয়ম ছিল—একবার হেরে গেলেও কেউ পয়েন্ট হারাবে না, আবার খেলার সুযোগ পাবে। অন্যটার নিয়ম ছিল—একবার হারলে আবার খেলার সুযোগ পাবে, কিন্তু শুরুর ২০০ পয়েন্ট থেকে ৫ পয়েন্ট কাটা যাবে। যদিও এই পয়েন্টের কোনো মূল্য নেই। পয়েন্টে কিছু যায় আসে না। তবু। আমি দেখেছি যাদের পয়েন্ট কাটা হয়নি, তারা অন্যদের তুলনায় আড়াই গুণ বেশি চেষ্টা করেছে। তাদের সফলতার হারও ১৬ শতাংশ বেশি। পয়েন্টের দিকে যাদের নজর দিতে হয়নি, তারা শিখেছেও বেশি।
যা বোঝাতে চাইছি, তার আরেকটা বড় উদাহরণ হলো ভিডিও গেম। সুপার মারিও ব্রাদার্স গেমটা যখন প্রথম এল, শয়তান বাউজারের হাত থেকে রাজকন্যা পিচকে বাঁচাতে আমি আর আমার বন্ধুরা মরিয়া ছিলাম। প্রতিদিন স্কুলে গিয়েই একজন আরেকজনকে জিজ্ঞেস করতাম, ‘কোন লেভেলে আছ? গেমটা শেষ করতে পেরেছ?’ আমরা কিন্তু কখনোই জানতে চাইতাম না, ‘তুমি কতবার মরেছ? কয়বার খেলেছ?’
ভিডিও গেমের ক্ষেত্রে যেটা হয়—একবার না পারলেও তুমি কিন্তু কখনোই ভাবো না, ‘কীভাবে এই ভুলটা করলাম! আমি আর জীবনেও খেলব না!’ বরং তুমি ভাবো, ‘আচ্ছা! ওখানে একটা বড় গর্ত আছে। তার মানে পরেরবার আমাকে আরও জোরে লাফ দিতে হবে।’ ভিডিও গেমে ব্যর্থতার দিকে নজর না দিয়ে জেতার দিকে মনোযোগ থাকে বলেই আমরা খুব অল্প সময়ে অনেক কিছু শিখে ফেলি।
এই মনোভাব কিন্তু স্রেফ ইতিবাচকতা কিংবা হাল না ছাড়ার চেয়েও বেশি কিছু। এর মধ্য দিয়ে ব্যর্থতাকে পাশ কাটিয়ে আবার চেষ্টা করার চর্চা হয়। তোমরা যদি এত কষ্ট, পরিশ্রম না করেই আজকের দিনটা পেয়ে যেতে, তাহলে কি এত আনন্দ হতো? অতএব জেনে রাখো, নদী পার হতে গিয়ে গা ভেজানোটাই নিয়ম।
সম্পর্কের গুরুত্ব
এখন একটা সুখবর দিই। নদীটা তুমি একা পেরোচ্ছ না। তাই আমার তৃতীয় উপদেশ—সম্পর্কের যত্ন নাও। বড় হওয়ার একটা দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, জীবনে ব্যস্ততা বেড়ে যায়। স্কুলজীবনে তোমার নিশ্চয়ই অনেক ভালো বন্ধু ছিল। যত বড় হবে, ভালো বন্ধু বানানো তত কঠিন হবে। এটা কোনো ভালো কথা নয়। কারণ, আমাদের তো সামাজিক প্রাণীই হওয়ার কথা ছিল। এখনকার সমাজ আমাদের একা থাকতে শেখায়। এখন তুমি রান্নাঘরে বসেও বোর্ড মিটিংয়ে অংশ নিতে পারো, গোসল করতে করতে খাবার অর্ডার করতে পারো, টয়লেটে বসেও সেরে নিতে পারো ব্যাংকের কাজ। তোমার বাসা থেকে বের না হয়েই তুমি নতুন বাসা দেখতে পারো। বড় বড় শহরে তুমি সবার চোখে অচেনা হয়ে বসবাস করতে পারো।
এ কারণেই অর্থবহ সম্পর্ক গড়ে তোলা দরকার। অনেকের কাছেই কাজটা খুব কঠিন মনে হতে পারে। তাই নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে একটা পরামর্শ দেব। আমাদের মস্তিষ্ক প্রমাণ না পেলে কোনো কিছু বিশ্বাস করতে চায় না। এই প্রবণতাকেই একটু অন্যভাবে ব্যবহার করো। স্বজন, বন্ধুদের বলতে শুরু করো, ‘আমার সৌভাগ্য, আমার জীবনে তোমরা আছ।’ বলতে বলতে একসময় দেখবে মস্তিষ্কই এর প্রমাণ খুঁজে নেবে। মস্তিষ্ক এভাবেই কাজ করে। যদি নিজেকে বলতে শুরু করো, আমার আশপাশের সবাই ভালো মানুষ। মস্তিষ্ক তাদের ভালো দিকগুলোই খুঁজবে।
তবে দুঃখজনকভাবে উল্টোটাও সত্য। যদি ভাবতে থাকো সবাই তোমাকে দুঃখ দিতে চায়, তুমি সেই প্রমাণই বারবার পাবে। যে দম্পতি সব সময় একজন আরেকজনের খারাপ উদ্দেশ্য খোঁজে, গবেষণা বলে তাঁদের বিচ্ছেদের আশঙ্কাই বেশি। তোমার সঙ্গী স্বার্থপর, অবিবেচক, ইচ্ছা করে ময়লা ফেলার কাজটা তোমার ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে, এটা যদি মাথার ভেতর ঢুকিয়েই নাও, তাহলে একটা চক্রের মধ্যে আটকা পড়ে যাবে। তোমার মস্তিষ্ক তোমার ধারণাকে জোরালো করতে আরও প্রমাণ খুঁজতে থাকবে। এই তরিকা শুধু বন্ধু, স্বজন, পরিবারের ক্ষেত্রে নয়, একেবারে অপরিচিত মানুষের জন্যও প্রযোজ্য। জর্জ কারলিন (মার্কিন কমেডিয়ান) যেমনটা বলেছিলেন, ‘যে আমার চেয়ে ধীরে গাড়ি চালাচ্ছে, সে বোকা; আর যে আমার চেয়ে জোরে চালায়, সে পাগল।’
তাই বলি, নদী পেরোনোর সময় মস্তিষ্ককে আশপাশের মানুষের মধ্যে ইতিবাচক অভিপ্রায় খোঁজার প্রশিক্ষণ দাও। (সংক্ষেপিত ও ঈষৎ পরিমার্জিত)