বার্বি পুতুল এত জনপ্রিয় কেন? জেনে নিন এর বৃত্তান্ত
‘বার্বি’ নামটা কে না শুনেছে! দুনিয়ার অন্যতম জনপ্রিয় এই পুতুলের খ্যাতি কোনো অংশেই মানব–তারকার চেয়ে কম না। আজ মুক্তি পেল এই পুতুলকে নিয়ে হলিউডে বানানো সিনেমা বার্বি। এ সুযোগে বার্বির বৃত্তান্ত জানাচ্ছেন গোলাম মমিত
খেলনার দোকানে গেলে এখনো চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকি। তোমার অবস্থাও যে আমার মতো, সে তো জানা কথা। আর তোমার মতো দুনিয়ার বাকি শিশু–কিশোরও খেলনা বলতে পাগল। এ কারণে দুনিয়ায় খেলনা বানানোর কোম্পানির সংখ্যাও অঢেল। বেশির ভাগ মানুষ বা কোম্পানি অবশ্য ভাবে, শিশুদের খেলনা দেখতে–শুনতেও হবে শিশুদের মতো। পুতুল বানালেও সেটা হতে হবে বাচ্চা পুতুল।
যুক্তরাষ্ট্রের রুথ হ্যান্ডলার কিন্তু একটু অন্যভাবে ভেবেছিলেন। আর রুথের মাথায় ভাবনাটা ঢুকিয়েছিল তাঁর শিশুকন্যা বারবারা। বলছি ১৯৫০–এর দশকের কথা। আর দশটা শিশুর মতো বারবারাও পুতুল বানিয়ে খেলতে ভালোবাসত। তবে তার পুতুলগুলো ছিল কাগজ কেটে বানানো তরুণী বা মাঝবয়সী পুতুল। সেসব পুতুলের আবার নানান পেশা, কেউ ছাত্র, কেউ চাকুরে।
রুথের মনে প্রশ্ন, এসব পুতুল দিয়ে খেলতে খেলতে বারবারা কি নিজেকে বড় মানুষ হিসেবে কল্পনা করে? তবে রুথ নিশ্চিত, এসব পুতুল দিয়ে খেলতে বেজায় আনন্দ পাচ্ছে বারবারা। তাই এটাও বুঝলেন, এমন পুতুল বাণিজ্যিকভাবে বানালে হইচই পড়ে যাবে।
বার্বি এল বাজারে
ভাবনাটাকে সত্যি করে তুলতে দ্রুত কাজে নেমে পড়লেন রুথ। আর সে সময় জার্মানিতে গিয়ে দেখলেন, তাঁর ভাবনার মতোই একটা পুতুল তত দিনে বাজারে এসে গেছে। ‘বিল্ড লিলি’ নামের ওই জার্মান পুতুল বাজারে এসেছিল ১৯৫২ সালে। দেশে ফিরেই বিল্ড লিলি আর নিজের কল্পনার মিশেলে একটা পুতুল দাঁড় করালেন। আর ১৯৫৯ সালের ৯ মার্চ রুথের হাত ধরে সেটাকে বাজারে আনল বিশ্বখ্যাত মার্কিন খেলনা নির্মাতা কোম্পানি ম্যাটেল ইনকরপোরেটেড।
কালো পনিটেইল চুল, নীল চোখ, টুকটুকে লাল ঠোঁট, ছিপছিপে গড়ন, পরনে জেব্রার মতো সাদা–কালো ডোরাকাটা সাঁতারের পোশাক—তরুণী পুতুলটার পুরো নাম বারবারা মিলিসেন্ট রবার্টস, ডাকনাম বার্বি। বার্বিকে লুফে নিল শিশুরা। প্রথম বছরেই বিক্রি হলো প্রায় সাড়ে ৩ লাখ পিস।
স্বপ্ন দেখানো পুতুল
এ পর্যন্ত দেড় শর বেশি পেশাজীবীর চরিত্রে বার্বিকে দেখা গেছে। অগ্নিনির্বাপক থেকে সাংবাদিক, প্রকৌশলী থেকে চিকিৎসক—অনুপ্রেরণা দেওয়ার মতো প্রায় সব পেশাজীবী হিসেবেই শিশুদের হাতে উঠেছে এই পুতুল। মানুষ যাওয়ার চার বছর আগেই চাঁদে গেছে বার্বি! আক্ষরিক অর্থে নয়, কল্পনায় চাঁদের বুকে পা রেখেছিল মহাকাশচারী বার্বি। অর্থাৎ বার্বির মধ্য দিয়ে শিশুদের বড় স্বপ্ন দেখাতে ম্যাটেল কোনো কার্পণ্য করেনি।
১৯৯২ সাল থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবেও দাঁড়াচ্ছে বার্বি! যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বার্বির জন্য রীতিমতো ভোটের প্রচারণাও চালায় ম্যাটেল। অনেকেই বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে নারীর স্বাধীনতা ও পেশা নির্বাচনে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে বার্বি।
বার্বিকে শিশুদের রোল মডেল করতে চেয়েছিল ম্যাটেল। তাই ১৯৬৭ সাল থেকে বিখ্যাত ব্যক্তিদের আদলে তৈরি বার্বি বাজারে ছাড়তে শুরু করে তারা। শুরুটা হয় ইংরেজ সুপারমডেল টুইগিকে দিয়ে। এরপর ব্রিটিশ অভিনেত্রী অড্রে হেপবার্ন, মার্কিন গায়িকা ডায়ানা রস, এমনকি হ্যারি পটারের স্রষ্টা জে কে রোলিংয়ের মতো দেখতে বার্বিরও দেখা মেলে।
বার্বির প্রভাব কতটা, বুঝতে চাইলে ইংরেজিতে বার্বি লিখে গুগল করতে পারো। দেখবে, কম্পিউটারের পর্দাটাই বদলে গেছে। গোলাপি রংটাই যেন নিজের করে নিয়েছে বার্বি।
আছে সমালোচনা
বিপুল ভালোবাসার পাশাপাশি বার্বিকে নিয়ে সমালোচনাও কম হয়নি। যথেষ্ট কারণও অবশ্য আছে। মানুষ হিসেবে আমরা কেউ নিখুঁত নই। এই নিখুঁত না হওয়াটা জীবনেরই অংশ। খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। কিন্তু শুরু থেকেই বার্বি ছিল শারীরিকভাবে ত্রুটিহীন। ফলে বার্বির সঙ্গে তুলনা করে শিশুরা নিজেকে অসুন্দর বা তুচ্ছ ভাবতে পারে।
তা ছাড়া গোড়ার দিকে বার্বির গায়ের রং কেবল সাদাই ছিল। তাই প্রশ্ন উঠেছিল, গায়ের রং সাদা মানেই সুন্দর? মোটেও না, সৌন্দর্যের সঙ্গে গায়ের রঙের কোনো সম্পর্ক নেই। তাহলে বার্বির গায়ের রং সব সময় কেন সাদা হবে?
এসব প্রশ্নের মুখে পড়ে ১৯৮০ সালে ম্যাটেল বাজারে আনে কালো গায়ের রঙের বার্বি। সেই পথ ধরে এ পর্যন্ত ৯ রকমের গড়ন, ৩৫ রকমের গায়ের রং, ৯৪ রকমের চুলের ধরন নিয়ে বাজারে এসেছে বার্বি। এমনকি শারীরিক ও মানসিকভাবে নাজুক চরিত্রের বার্বিও তৈরি করেছে ম্যাটেল।
খেলনা থেকে সিনেমা
বার্বিকে সবার মনে আলাদা একটা চরিত্র হিসেবে দাঁড় করাতে চেয়েছিল ম্যাটেল। যেন শিশুরা শুধু চেহারায় বার্বির মতো হতে না চায়, তারা যেন বার্বির অনুকরণীয় চরিত্রগুলোর মতোই সুন্দর হওয়ার স্বপ্ন দেখে।
সেই পরিকল্পনায় বার্বিকে তারা প্রথম বড় পর্দায় আনে ১৯৮৭ সালে। সিনেমাটির নাম ছিল বার্বি অ্যান্ড দ্য রকার্স: আউট অব দিস ওয়ার্ল্ড। ওতে বার্বি আর তার বন্ধুরা মিলে মহাকাশে একটা দাতব্য কনসার্ট করে। পৃথিবীর বাইরে গিয়ে গান করার চমকপ্রদ গল্প নিয়ে বানানো এই সিনেমার দৈর্ঘ্য ছিল মোটে ২০ মিনিট। কারোরই তাতে মন ভরেনি। সিনেমার জগতে বার্বির ঘুরে দাঁড়ানোর বছরটা ২০০১। সে বছর মুক্তি পায় পূর্ণদৈর্ঘ্য অ্যানিমেশন সিনেমা বার্বি ইন দ্য নাটক্র্যাকার।
ওই সিনেমার সাফল্যের পর একে একে মুক্তি পায় বার্বি অ্যাজ রাপানজেল, বার্বি অব সোয়ান লেক, বার্বি অ্যাজ দ্য প্রিন্সেস অ্যান্ড দ্য পপার, বার্বি: ফেইরিটোপিয়া ইত্যাদি সিনেমা। এ পর্যন্ত বার্বিকে নিয়ে বানানো মোট সিনেমার সংখ্যা ৪৩।
আজ মুক্তি পাওয়া বার্বি হতে যাচ্ছে বার্বিকে নিয়ে বানানো প্রথম লাইভ অ্যাকশন সিনেমা অর্থাৎ অ্যানিমেশনের বাইরে রক্ত-মাংসের মানুষের অভিনয় করা সিনেমা। নতুন এই অভিজ্ঞতা দর্শক কীভাবে নেয়, সেটাই দেখার বিষয়।